মওলবি আশরাফ
ভাবুন তো একবার, আপনি অবসরে পড়বার জন্য একটি লাইব্রেরিতে ঢুকলেন, আর বুকশেলফে হাত রাখতেই বের হয়ে এলো এক হাজার বছরেরও পুরনো হাতে লেখা কোরআন শরিফ কিংবা নবীজীবনী! লাইব্রেরিয়ান আপনাকে নিষেধ করছেন না আর কোথাও ‘সংরক্ষিত’ ট্যাগও নেই! আপনার সামনে দুষ্প্রাপ্য প্রায় চার হাজার পাণ্ডুলিপি, এর মধ্যে দুই হাজারের বেশি আরবি পাণ্ডুলিপি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আপনি নির্বিঘ্নে নবম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াতে পারছেন। এমনই অভিজ্ঞতা হবে মরক্কোর ফেজ শহরের আল কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল ফিহরিয়া নামক এক নারীর হাত ধরে। তিনি ছিলেন ইফ্রিকিয়াজয়ী বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি উকবা বিন নাফে’র বংশধর। বর্তমান তিউনিসিয়ায় জন্ম নেওয়া এই বিদুষী নারী পৈতৃকসূত্রে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে যখন মরক্কোর ফেজ শহরে হিজরত করেন, সেখানে তিনি ‘সদকায়ে জারিয়ার’ নিয়তে একটি মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, ৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের অনুসন্ধান অনুযায়ী এটিই পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
কারাওইন মসজিদের দার আল-মুওয়াক্কিতে ১৪ শতকে নির্মিত জলঘড়ির পুনর্নির্মাণ। ছবি: উইকিপিডিয়া
একাডেমিক ডিগ্রির জন্য সনদ বা সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রচলন শুরু হয় আল কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এর আগে সার্টিফিকেটের প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নেন, ফাতিমা আল ফিহরিয়া ছিলেন তাদের একজন। পরবর্তীতে ইবনে খালদুন, ইবনে রুশদ, আল ইদরিসি ও পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টারের মতো অনেক জগদ্বিখ্যাত গুণীজনই এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি যুক্ত হয় প্রতিষ্ঠার ছয় শতক পরে, ১৩৫৯ সালে। সেই সময় ইউরোপে বিজ্ঞান ও বীজগণিতের চর্চা ব্যাপকতা লাভ করে। এই লাইব্রেরিতে তাই ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি অসংখ্য বীজগণিত ও বিজ্ঞানের বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মুসলিম দুনিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থল, এখানে যে বিষয়ের চর্চা হতো, ইউরোপে তার প্রভাব পড়ত। যার ফলে কয়েক শতকের মধ্যে ইউরোপে রনেসাঁসের সূত্রপাত হয়।

ছবি: উইকিপিডিয়া
২০১২ সালে মরক্কোর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই লাইব্রেরিটি সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। বছরের পর বছর আর্দ্রতার কারণে ও সংস্কারের অভাবে লাইব্রেরির অনেকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ছাদের টালি ভাঙা, কাঠের বিম চিড় ধরা, বিদ্যুৎ লাইনগুলো খোলা, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা অচল এবং অনেক দুষ্প্রাপ্য বই একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সরকার মরক্কো-কানাডীয় স্থপতি আজিজা শাউনিকে এ লাইব্রেরি সংস্কারের দায়িত্ব দেয়। ২০১৭ সালে তিনি এবং তার স্থপতিদের দল ৬৫০ বছরের পুরনো ভবনের সংস্কারকার্য শুরু করেন। ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল, যেমন লাইব্রেরির ভিত্তি পুনর্নির্মাণ, একটি নতুন পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন, এবং আইকনিক সবুজ ছাদে টাইলস সংস্কার করা। মূল্যবান কাজগুলোকে আর্দ্রতা থেকে আরও ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে তারা এয়ার কন্ডিশনার স্থাপন করেন। অন্যান্য আধুনিক উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে সোলার প্যানেল স্থাপন, বিরল বইয়ের কক্ষ সুরক্ষিত করতে ডিজিটাল লক, এবং মূল্যবান পাণ্ডুলিপি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি হাই-টেক ল্যাবরেটরি তৈরি করা। লাইব্রেরিটি আগে শুধুমাত্র পণ্ডিত ও গবেষকদের জন্য খোলা ছিল। বর্তমানে এটির একটি অংশ সাধারণ জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, যেখানে একটি প্রদর্শনী কক্ষ ও একটি ছোট ক্যাফে আছে।

ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বুদ্ধিজীবী, ইসলামি গবেষক ও ইতিহাসবিদরা নিয়মিত এই লাইব্রেরিতে আসেন। এখানে সংরক্ষিত আছে—
- নবম শতাব্দীর একটি কোরআন শরিফ
- ইসলামি আইনশাস্ত্র বিষয়ে ইবন রুশদের একটি দুর্লভ গ্রন্থ
- ইতিহাস, হাদিস, ফিকহ, ব্যাকরণ, ভূগোল, চিকিৎসা, রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সংগীত পর্যন্ত—সব জ্ঞানশাখার দুষ্প্রাপ্য সব পাণ্ডুলিপি।
- একমাত্র বিদ্যমান কপি হিসেবে সংরক্ষিত ২,০৩০টি গ্রন্থ।
তবে দুঃখের বিষয়, এই লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত অনেক পাণ্ডুলিপিই সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেছে। পুরনো রেজিস্ট্রারের সঙ্গে বর্তমান তালিকা মিলিয়ে দেখলেই তা বোঝা যায়। তবু যা আছে, তা অনন্য।
এই লাইব্রেরি ইসলামের সেই ‘সোনালি যুগের’ সাক্ষ্য বহন করে, যখন জ্ঞানচর্চা কেবল দুনিয়ামুখী কিংবা শুধুমাত্র আখেরাতকেন্দ্রিক ছিল না, বরং দুনিয়া ও আখেরাত—দুই জগতের সাথেই যুক্ত ছিল। মুসলমানরা তখন একই সাথে দুনিয়া ও আখেরাতকে ধারণ করেই অর্ধ দুনিয়া শাসন করত।
ওএফএফ/জিকেএস
এডমিন 












