০১:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কর্মচঞ্চল পাটুরিয়া ঘাট কেবলই স্মৃতি

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ০৬:০১:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫
  • 2

নদীর বুকে ভেসে আসা ফেরির হুইসেল, যাত্রী-হকারদের শোরগোলা, আর কুলির ঘামে ভেজা মুখ ছিল মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটের প্রতিদিনের চিত্র। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ততার স্রোতে মুখর থাকত এ ঘাট। কর্মচঞ্চল সেই দিনের গল্প এখন শুধুই স্মৃতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০২ সালে আরিচা ঘাট থেকে ফেরিঘাট স্থানান্তরের পর থেকে পাটুরিয়া ঘাট হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। প্রায় ২১টি জেলার মানুষ রাজধানী ঢাকায় যেতে বা ফিরতে ভরসা রাখতেন এ ঘাটের ওপর। ফেরি ও লঞ্চের হুইসেল, যাত্রীদের চলাচল, খাবারের দোকানের ধোঁয়া, ফেরিওয়ালাদের ডাক সব মিলিয়ে পাটুরিয়া ঘাট যেন ছিল এক জীবন্ত শহর।

ঘাটকে ঘিরে গড়ে ওঠে বাণিজ্যকেন্দ্র। অসংখ্য হোটেল, রেস্তোরাঁ, বোর্ডিং, দোকানপাটে জমজমাট ছিল ব্যবসা। কারো জীবিকা নির্ভর করত ফেরিঘাটের যাত্রীদের ওপর, কারো সংসার চলত এক কাপ চা বিক্রি করে। এ ঘাটই হয়ে উঠেছিল হাজারো মানুষের জীবনের আশ্রয়স্থল। কিন্তু সময় বদলে গেছে।

কর্মচঞ্চল পাটুরিয়া ঘাট কেবলই স্মৃতি

২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর সেই কোলাহলমুখর ঘাটে নেমে আসে নীরবতা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ এখন সরাসরি সেতু পেরিয়ে ঢাকায় আসেন, পাটুরিয়া ঘাটে আর আগের মতো যাত্রীর ভিড় নেই। একে একে বন্ধ হয়ে গেছে হোটেল, বোর্ডিং, দোকানপাট। ঘাটের কুলি, ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন।

আরও পড়ুন
পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের দৈনন্দিন ব্যস্ততা
তিন সংকট ভোগাচ্ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার যাত্রীদের

ট্রাক টার্মিনালের ক্যান্টিনের সাবেক ম্যানেজার মো. ইদ্রিস মিয়া বর্তমানে জীবিকার তাগিদে গাড়িতে গ্রিজ লাগানোর কাজ করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাটুরিয়া ঘাট যখন জমজমাট ছিল, তখন অনেক কেনাবেচা হতো। এখন পদ্মা সেতু নির্মাণের পর আর আগের মতো বেচাকেনা নেই। ঘাটে আর তেমন কোনো হইচই নেই। সেই কারণে ক্যান্টিনটি বন্ধ রাখতে হয়েছে।’

ঘাট এলাকায় ঘুরে ঘুরে আকর্ষণীয়ভাবে যাত্রীদের কাছে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন হবি প্রামাণিক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যখন এ ব্যবসা শুরু করেছিলাম। তখন সংসার চালাতে কোনো কষ্ট হতো না। এখন দেখা যাচ্ছে, পাটুরিয়া ঘাট প্রায় বন্ধ বলা চলে। অল্প কিছু গাড়ি চলে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর এদিকে গাড়ি একেবারে কমে গেছে। আমাদের এখন চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।’

পাটুরিয়া ৪ নম্বর ঘাটের পাশের ধুতরাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব অরুণ চন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ধরে ঘাটে মুদি দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ঘাটে ভালো বেচাকেনা হতো। পদ্মা সেতু হওয়ার পর মানুষ আর আসে না। ঘাট ধোয়া (পরিষ্কার) কেনাবেচা কমে গেছে। সেতু হওয়ার পর হোটেল, দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে।’

কর্মচঞ্চল পাটুরিয়া ঘাট কেবলই স্মৃতি

পাটুরিয়া ঘাট হকার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল রব। তিনি দেখেছেন ঘাটের জমজমাট দিনগুলো। মলিন সময়েরও স্বাক্ষী তিনি। অভাবের কারণে এ পেশা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা এ ঘাটে হকারি করি, সবাই স্থানীয়। আগে ভালোভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতাম। পদ্মা সেতু হওয়ার পর গাড়ির সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে এখন কেউই পরিবার নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারে না। সাতদিনের মধ্যে তিনদিন ডাল ভাত খেয়ে থাকতে হয়। অন্য কোনো ব্যবসার কথা ভাবছি এখন। আগে ঘাটে অসংখ্য গাড়ি আসত, এখন দিনে মাত্র ৫০ টা গাড়ি আসে। খুব কষ্টে জীবনযাপন করছি।’

ঘাটসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আব্দুল বাসেদ বলেন, ‘২০০২ সালে পাটুরিয়া ঘাট চালু হওয়ার পর আরিচা ঘাটের ব্যস্ততা ও উৎসবমুখর পরিবেশ এখানে স্থানান্তরিত হয়। তখন এখানে অনেক হোটেল ও দোকান গড়ে ওঠে। প্রায় এক থেকে দেড় হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তাদের জীবনও সুন্দরভাবে চলছিল। কিন্তু ২০২২ সালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে সমস্ত যাত্রী ও গাড়ি সেতু দিয়ে পার হচ্ছে।’

মো. সজল আলী/আরএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

ট্যাগঃ

শত কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে ২ ব্যক্তি আটক

কর্মচঞ্চল পাটুরিয়া ঘাট কেবলই স্মৃতি

আপডেট সময়ঃ ০৬:০১:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫

নদীর বুকে ভেসে আসা ফেরির হুইসেল, যাত্রী-হকারদের শোরগোলা, আর কুলির ঘামে ভেজা মুখ ছিল মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটের প্রতিদিনের চিত্র। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ততার স্রোতে মুখর থাকত এ ঘাট। কর্মচঞ্চল সেই দিনের গল্প এখন শুধুই স্মৃতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০২ সালে আরিচা ঘাট থেকে ফেরিঘাট স্থানান্তরের পর থেকে পাটুরিয়া ঘাট হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। প্রায় ২১টি জেলার মানুষ রাজধানী ঢাকায় যেতে বা ফিরতে ভরসা রাখতেন এ ঘাটের ওপর। ফেরি ও লঞ্চের হুইসেল, যাত্রীদের চলাচল, খাবারের দোকানের ধোঁয়া, ফেরিওয়ালাদের ডাক সব মিলিয়ে পাটুরিয়া ঘাট যেন ছিল এক জীবন্ত শহর।

ঘাটকে ঘিরে গড়ে ওঠে বাণিজ্যকেন্দ্র। অসংখ্য হোটেল, রেস্তোরাঁ, বোর্ডিং, দোকানপাটে জমজমাট ছিল ব্যবসা। কারো জীবিকা নির্ভর করত ফেরিঘাটের যাত্রীদের ওপর, কারো সংসার চলত এক কাপ চা বিক্রি করে। এ ঘাটই হয়ে উঠেছিল হাজারো মানুষের জীবনের আশ্রয়স্থল। কিন্তু সময় বদলে গেছে।

কর্মচঞ্চল পাটুরিয়া ঘাট কেবলই স্মৃতি

২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর সেই কোলাহলমুখর ঘাটে নেমে আসে নীরবতা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ এখন সরাসরি সেতু পেরিয়ে ঢাকায় আসেন, পাটুরিয়া ঘাটে আর আগের মতো যাত্রীর ভিড় নেই। একে একে বন্ধ হয়ে গেছে হোটেল, বোর্ডিং, দোকানপাট। ঘাটের কুলি, ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন।

আরও পড়ুন
পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের দৈনন্দিন ব্যস্ততা
তিন সংকট ভোগাচ্ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার যাত্রীদের

ট্রাক টার্মিনালের ক্যান্টিনের সাবেক ম্যানেজার মো. ইদ্রিস মিয়া বর্তমানে জীবিকার তাগিদে গাড়িতে গ্রিজ লাগানোর কাজ করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাটুরিয়া ঘাট যখন জমজমাট ছিল, তখন অনেক কেনাবেচা হতো। এখন পদ্মা সেতু নির্মাণের পর আর আগের মতো বেচাকেনা নেই। ঘাটে আর তেমন কোনো হইচই নেই। সেই কারণে ক্যান্টিনটি বন্ধ রাখতে হয়েছে।’

ঘাট এলাকায় ঘুরে ঘুরে আকর্ষণীয়ভাবে যাত্রীদের কাছে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন হবি প্রামাণিক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যখন এ ব্যবসা শুরু করেছিলাম। তখন সংসার চালাতে কোনো কষ্ট হতো না। এখন দেখা যাচ্ছে, পাটুরিয়া ঘাট প্রায় বন্ধ বলা চলে। অল্প কিছু গাড়ি চলে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর এদিকে গাড়ি একেবারে কমে গেছে। আমাদের এখন চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।’

পাটুরিয়া ৪ নম্বর ঘাটের পাশের ধুতরাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব অরুণ চন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ধরে ঘাটে মুদি দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ঘাটে ভালো বেচাকেনা হতো। পদ্মা সেতু হওয়ার পর মানুষ আর আসে না। ঘাট ধোয়া (পরিষ্কার) কেনাবেচা কমে গেছে। সেতু হওয়ার পর হোটেল, দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে।’

কর্মচঞ্চল পাটুরিয়া ঘাট কেবলই স্মৃতি

পাটুরিয়া ঘাট হকার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল রব। তিনি দেখেছেন ঘাটের জমজমাট দিনগুলো। মলিন সময়েরও স্বাক্ষী তিনি। অভাবের কারণে এ পেশা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা এ ঘাটে হকারি করি, সবাই স্থানীয়। আগে ভালোভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতাম। পদ্মা সেতু হওয়ার পর গাড়ির সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে এখন কেউই পরিবার নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারে না। সাতদিনের মধ্যে তিনদিন ডাল ভাত খেয়ে থাকতে হয়। অন্য কোনো ব্যবসার কথা ভাবছি এখন। আগে ঘাটে অসংখ্য গাড়ি আসত, এখন দিনে মাত্র ৫০ টা গাড়ি আসে। খুব কষ্টে জীবনযাপন করছি।’

ঘাটসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আব্দুল বাসেদ বলেন, ‘২০০২ সালে পাটুরিয়া ঘাট চালু হওয়ার পর আরিচা ঘাটের ব্যস্ততা ও উৎসবমুখর পরিবেশ এখানে স্থানান্তরিত হয়। তখন এখানে অনেক হোটেল ও দোকান গড়ে ওঠে। প্রায় এক থেকে দেড় হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তাদের জীবনও সুন্দরভাবে চলছিল। কিন্তু ২০২২ সালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে সমস্ত যাত্রী ও গাড়ি সেতু দিয়ে পার হচ্ছে।’

মো. সজল আলী/আরএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।