রাত নেমেছে শহরে। রাস্তার বাতিগুলো একে একে জ্বলছে, আর ঠিক তখনই গর্জে ওঠে কয়েকটি মোটরবাইকের ইঞ্জিন। হেলমেট ছাড়াই কয়েকজন তরুণ দৌড়াচ্ছে ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে। কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে, কেউ আবার হাসতে হাসতে উল্টো লেনে ঢুকে পড়ছে। তাদের কাছে এটি যেন এক ধরনের বিনোদন! কিন্তু এই বিনোদনের শেষ কোথায়?
বাংলাদেশের শহরগুলোতে গত এক দশকে মোটরবাইক শুধু যানবাহন নয়, হয়ে উঠেছে তরুণদের স্টাইল ও স্বাধীনতার প্রতীক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া রাইড ভিডিও, রোড ট্রিপের ছবি, কিংবা বাইক ক্লাবের আয়োজন সব কিছুই তরুণদের মনে সৃষ্টি করেছে এক গতির মোহ। অনেকে মনে করে, গতি মানেই শক্তি, আত্মবিশ্বাস এবং আধুনিকতা। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালেই লুকিয়ে আছে ভয়াবহ বিপদ।
প্রায়ই দেখা যায়, হেলমেট ছাড়া চালানো, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য, কিংবা একহাতে মোবাইল চালাতে চালাতে বাইক চালানো এসব এখন যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর হাতিরঝিল, পূর্বাচল, উত্তরা ও আগারগাঁওয়ের ফাঁকা রাস্তায় হরহামেশেই দেখা যায় বেপরোয়া বাইকের দৃশ্য।

নিয়মিত বাইক চালিয়ে অফিস যাতায়াত করেন রাইডার রিফাত। তিনি বলেন, ‘রাতের দিকে রাস্তা ফাঁকা থাকলে অনেকেই তখন গতি বাড়িয়ে দেয়, কেউ কেউ ভিডিও করে। কিন্তু সত্যি বলতে, একটু অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থেকেই এসব করে তারা। এরা বুঝতে চায় না একটা ভুল ব্রেকে জীবনটাই শেষ হয়ে যেতে পারে।’
হাতিরঝিলে প্রায় হাঁটতে আসেন সুমনা আক্তার। তিনি বলেন, বিকেল-সন্ধ্যায় এদিকে হাঁটতে কখনো কখনো অস্বস্তি লাগে। কিছু তরুণরা এমন গতিতে বাইক চালায়, মনে হয় যেন প্রতিযোগিতা চলছে। সঙ্গে উচ্চশব্দের হর্ণ তো আছেই। মনে হয় এই বুঝি গায়ে এসে পড়লো। পুলিশও থাকে, কিন্তু ওরা বেপরোয়া গতিতে পালিয়ে যায়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে মোটরবাইক-সম্পর্কিত দুর্ঘটনার হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের উল্লেখযোগ্য অংশই মোটরসাইকেল চালক বা আরোহী। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, কৈশোর ও তরুণ বয়স এমন এক সময়, যখন উত্তেজনা আর ঝুঁকির প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী লরেন্স স্টেইনবার্গ এর গবেষণায় দেখা গেছে, এই বয়সে মস্তিষ্কের যে অংশ আনন্দ ও উত্তেজনা অনুভব করে, সেটি দ্রুত বিকশিত হয়; কিন্তু নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অংশটি তুলনামূলক ধীরগতিতে পরিপক্ব হয়। ফলে তরুণেরা মুহূর্তের আনন্দে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে ঝোঁকে। যা অল্প সময়ের জন্য আনন্দ দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ডেকে আনে বিপর্যয়। তাদের কাছে গতি, শব্দ ও রোমাঞ্চ একধরনের তৃপ্তি দিলেও, অনেক সময় তা হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
অন্যদিকে, বাইকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের সামাজিক প্রভাবও কম নয়। শহরের ব্যস্ত এলাকায় বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানোয় পথচারী, নারী, এমনকি শিশুদের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ে। অনেক সময় স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা এ ধরনের রাইড দেখে অনুপ্রাণিত হয়, কিন্তু সচেতনতা না থাকায় তারাও অল্প বয়সে গতি প্রতিযোগিতায় নামছে।

তবে পুরো দায় তরুণদের নয়। রাস্তার অব্যবস্থা, নিরাপদ লেনের অভাব, কঠোর আইন প্রয়োগের ঘাটতি সব মিলিয়ে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করেছে। অনেক দেশে বাইক চালকদের জন্য আলাদা লেন, গতি সীমা সেন্সর এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশেও এখন সময় এসেছে এই বাস্তবতা বুঝে পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থাপনার।
যারা সত্যিকারের বাইকপ্রেমী, তারা জানেন নিরাপত্তাই রাইডিংয়ের মূল সৌন্দর্য। হেলমেট, গ্লাভস, প্রোটেকটিভ জ্যাকেট এসব স্টাইলের জন্য নয়, জীবন বাঁচানোর ঢাল। ‘রাইড টু এক্সপ্লোর, নট টু এক্সপ্লোড’ অর্থাৎ ভ্রমণে বেরোও জানার জন্য, ধ্বংস ডেকে আনতে নয়। এই বোধটিই ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজে।
আজ ২২ অক্টোবর, জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। তাই প্রশ্নটা থেকেই যায়, গতি কি স্বাধীনতার প্রতীক, নাকি জীবনের ঝুঁকি? উত্তরটা চালকের বাইকের হ্যান্ডেলে, যেখানে বিনোদনের চেয়ে দায়িত্ববোধটিই হওয়া উচিত সবচেয়ে বড় শক্তি।
সূত্র: পিএমসি
আরও পড়ুন
ডোপামিন আসক্তি থেকে পর্নোগ্রাফির ফাঁদে তরুণরা
একবার আলমের চা খাইলে, অন্য চা পাইনসা লাগে
এসএকেওয়াই/জিকেএস
এডমিন 








