০৭:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাট শিল্পে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগে আগ্রহী চীন, জানালেন প্রেস সচিব

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ১২:০১:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৫
  • 18

বাংলাদেশের পাট শিল্পে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগে চীন আগ্রহী বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শনিবার (২৯ নভেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) আয়োজিত চার দিনব্যাপী ‘কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।

প্রেস সচিব বলেন, পাট শিল্পে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় এ খাতকে কেন্দ্র করে চীনা উদ্যোক্তারা কাঁচা পাট থেকে শুরু করে প্রস্তুত পাটপণ্যসহ সব ক্ষেত্রেই যৌথ উদ্যোগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও আধুনিক উৎপাদন সুবিধা গড়তে চাচ্ছেন। আমরা আশা করছি, এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হলে দেশের পাট শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয় এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য গতি আসবে।

শফিকুল আলম সম্মেলনে ‘কৃষি ও খাদ্যে বিনিয়োগ: প্রক্রিয়াজাত পণ্য বাণিজ্যিকীকরণ ভ্যালুচেইন গঠন’ শীর্ষক অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু খালিদের সঞ্চালনায় এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন।

প্রেস সচিব বলেন, পাট বৈচিত্র্যকরণ নিয়ে আমরা যতই কথা বলি না কেন বাস্তবে তেমন অগ্রগতি নেই। কারণ পাট পচানো এখন আর কেউ করতে চান না। পুরোনো কষ্টকর পদ্ধতি মানুষের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চীনা বিনিয়োগকারীরা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে এক মিলিয়ন টন পাট প্রক্রিয়াকরণ, জৈবসার, জ্বালানি ও সাশ্রয়ী প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরি করতে আগ্রহী। সঠিক প্রযুক্তি যুক্ত হলে পাট আবারও বৃহৎ বৈশ্বিক বাজার দখল করতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের গতিপথ, ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের যাত্রা সবকিছুই বড় পরিমাণে নির্ধারণ করে কৃষি খাত। কৃষি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক সম্পর্ক, এমনকি অর্থনৈতিক সক্ষমতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ
শফিকুল আলম বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ বছর ছিল ১৯৭৪। ড. নামি হোসেনের সাম্প্রতিক প্রকাশিত গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, গবেষকের হিসাবে সেই দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। তৎকালীন সরকারের অদক্ষতা, দুর্বল রিজার্ভ, বৈশ্বিক কৃষিপণ্যের রাজনীতি ও বাজারব্যবস্থার ব্যর্থতা দুর্ভিক্ষকে তীব্রতর করেছিল। একই সঙ্গে খাদ্য মজুতদারি ও অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭৪ সালের সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রতিটি সরকারের নীতিনির্ধারণে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া খাদ্য আমদানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য যেকোনো বৈশ্বিক টানাপোড়েনে পরিস্থিতি দ্রুত সংকটে গড়াতে পারে।

তিনি জানান, বর্তমানে ছয় থেকে আট মিলিয়ন টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। অথচ ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বা কোনো দেশের হঠাৎ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা- এসব কারণে খাদ্য আমদানি কঠিন হয়ে ওঠে। তাই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী রিজার্ভ, পর্যাপ্ত মজুত ও দ্রুত আমদানির সক্ষমতা অপরিহার্য।

উৎপাদন ও মজুত
কৃষিতে বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারের কথা উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে নেদারল্যান্ডসের মতো কৃষিতে প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন বাড়াতে হবে। নেদারল্যান্ডস ছোট দেশ হয়েও বছরে ১৩৩ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। বাংলাদেশেরও সীমিত জমিতে উৎপাদন দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু শুধু উৎপাদন বাড়লেই হবে না, ক্ষুদ্র কৃষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি। হঠাৎ বড় আকারে ফসল উঠলে দাম পড়ে যায় এবং কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। তাই প্রতিটি গ্রামে ছোট আকারে হিমাগার, আধুনিক সংরক্ষণব্যবস্থা, নতুন বাজার ও রপ্তানির সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।

কৃষি, রাজনীতি ও বৈশ্বিক বাণিজ্য একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। যেমন, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন সংকটের সময়ে বাংলাদেশ সয়াবিন আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী ফার্ম লবিকে বাংলাদেশের অনুকূলে এনেছে। এটি নতুন ধরনের বৈদেশিক নীতির কৌশল, উল্লেখ করেন শফিকুল আলম

আরও পড়ুন
মৎস্য ও প্রাণি সম্পদেও ভর্তুকি দরকার: ফরিদা আখতার
কৃষির আধুনিকায়নে আসছে ২৫ বছরের মহাপরিকল্পনা
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কাজ করছে সরকার: ফরিদা আখতার

মজুত সক্ষমতা বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে ২০ লাখ টন শস্য সংরক্ষণ করা হয়। এটি বাড়িয়ে ৫০ লাখ টনে নেওয়া উচিত। যাতে বৈশ্বিক সংকটের সময়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা যায়। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততার বিস্তার, জমির ব্যবহার কমে আসাসহ বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে নতুন জাত, নতুন প্রযুক্তি ও খাতভিত্তিক গবেষণা জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি।

কৃষিজমি রক্ষা
আবাসন বিস্তার করে কৃষিজমি নষ্ট করার প্রবণতার কঠোর সমালোচনা করেন প্রেস সচিব। তিনি বলেন, গ্রামের বাড়িঘর ফাঁকা পড়ে থাকা, কিন্তু কৃষিজমি ক্রমাগত কমে যাওয়া- এই বাস্তবতা মোকাবিলায় পরিকল্পিত গ্রাম উন্নয়ন জরুরি।

আমাদের ভবিষ্যৎ কৃষির বাইরে নয় উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, যে সরকার আসবে, যারাই নীতিনির্ধারক হোক, সবারই লক্ষ্য হওয়া উচিত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং কৃষিজমি ও কৃষককে সুরক্ষা দেওয়া। আমরা হয়তো নেদারল্যান্ডস হবো না কিন্তু লক্ষ্য রেখে ১০ বছর কাজ করলে অনেকটাই এগোনো সম্ভব।

বিপণনব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা
সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পার্টনার প্রোগ্রামের এজেন্সি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ও উপসচিব ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও বাজারসংযোগ দুর্বল এবং বিপণনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। পার্টনার প্রোগ্রামের ১০টি ডিএলআই বাস্তবায়নে সাতটি সরকারি সংস্থা যুক্ত হলেও সমন্বয় ঘাটতি রয়েছে। গ্যাপভিত্তিক নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, ভ্যালুচেইন প্রমোশনাল বডি গঠন এবং বাজারব্যবস্থা শক্তিশালী করার মাধ্যমে কৃষকের প্রকৃত লাভ নিশ্চিত করা এখন জরুরি।

এক্সপোর্ট অ্যান্ড প্রাইভেট সেক্টর কনসাল্টেন্ট ড. মো. মাহবুবুল আলম বলেন, পার্টনার প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারাদেশে ২০ হাজার কৃষি উদ্যোক্তা গড়ে তোলা হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, ইনকিউবেশন সাপোর্ট, সার্টিফিকেশন সহায়তা ও যন্ত্রপাতি কেনায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আসনের ৬০ শতাংশ সংরক্ষিত। আটটি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ এবং ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে উদ্যোক্তাদের ভ্যালুচেইনে প্রবেশ সহজ করা হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যের মাত্র পাঁচ ভাগ প্রক্রিয়াজাত হওয়ায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বড় সম্ভাবনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

প্রবন্ধ উপস্থাপনে পার্টনার প্রকল্পের (ডিএএম উইং) সিনিয়র মনিটরিং অফিসার মো. বায়েজিদ বোস্তামী বলেন, কৃষি ব্যবসায় যুবক ও নারীদের সম্পৃক্ত করে ২০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি এবং পাঁচটি প্রধান কৃষিপণ্যের ভ্যালুচেইন শক্তিশালী করার কাজ চলছে। আম, আলু, কাঁঠাল, টমেটো ও সুগন্ধি চাল- এই পাঁচ পণ্যে ভ্যালুচেইন প্রমোশনাল বডি গঠনের কাঠামো ও নীতিমালা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ৪২৬টি ম্যাপস ও ৬৬টি উপজেলা সংগঠন গঠিত হয়েছে। এসব কাঠামো উৎপাদক থেকে বাজার পর্যন্ত শক্তিশালী সংযোগ স্থাপন করবে এবং রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়াবে।

চারজনকে সম্মাননা
এসময় ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক ও বিএজেএফের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রিয়াজ আহমেদ, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও বিএজেএফের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রেজাউল করিম সিদ্দিক, বিএজেএফের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা স্ট্রিমের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক গোলাম ইফতেখার মাহমুদ এবং বর্তমান সভাপতি সাহানোয়ার সাঈদ শাহীনের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনে সহযোগী হিসেবে রয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

এমওএস/একিউএফ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

ট্যাগঃ
জনপ্রিয় খবর

পাট শিল্পে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগে আগ্রহী চীন, জানালেন প্রেস সচিব

আপডেট সময়ঃ ১২:০১:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের পাট শিল্পে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগে চীন আগ্রহী বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শনিবার (২৯ নভেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) আয়োজিত চার দিনব্যাপী ‘কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।

প্রেস সচিব বলেন, পাট শিল্পে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় এ খাতকে কেন্দ্র করে চীনা উদ্যোক্তারা কাঁচা পাট থেকে শুরু করে প্রস্তুত পাটপণ্যসহ সব ক্ষেত্রেই যৌথ উদ্যোগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও আধুনিক উৎপাদন সুবিধা গড়তে চাচ্ছেন। আমরা আশা করছি, এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হলে দেশের পাট শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয় এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য গতি আসবে।

শফিকুল আলম সম্মেলনে ‘কৃষি ও খাদ্যে বিনিয়োগ: প্রক্রিয়াজাত পণ্য বাণিজ্যিকীকরণ ভ্যালুচেইন গঠন’ শীর্ষক অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু খালিদের সঞ্চালনায় এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন।

প্রেস সচিব বলেন, পাট বৈচিত্র্যকরণ নিয়ে আমরা যতই কথা বলি না কেন বাস্তবে তেমন অগ্রগতি নেই। কারণ পাট পচানো এখন আর কেউ করতে চান না। পুরোনো কষ্টকর পদ্ধতি মানুষের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চীনা বিনিয়োগকারীরা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে এক মিলিয়ন টন পাট প্রক্রিয়াকরণ, জৈবসার, জ্বালানি ও সাশ্রয়ী প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরি করতে আগ্রহী। সঠিক প্রযুক্তি যুক্ত হলে পাট আবারও বৃহৎ বৈশ্বিক বাজার দখল করতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের গতিপথ, ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের যাত্রা সবকিছুই বড় পরিমাণে নির্ধারণ করে কৃষি খাত। কৃষি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক সম্পর্ক, এমনকি অর্থনৈতিক সক্ষমতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ
শফিকুল আলম বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ বছর ছিল ১৯৭৪। ড. নামি হোসেনের সাম্প্রতিক প্রকাশিত গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, গবেষকের হিসাবে সেই দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। তৎকালীন সরকারের অদক্ষতা, দুর্বল রিজার্ভ, বৈশ্বিক কৃষিপণ্যের রাজনীতি ও বাজারব্যবস্থার ব্যর্থতা দুর্ভিক্ষকে তীব্রতর করেছিল। একই সঙ্গে খাদ্য মজুতদারি ও অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭৪ সালের সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রতিটি সরকারের নীতিনির্ধারণে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া খাদ্য আমদানিনির্ভর দেশগুলোর জন্য যেকোনো বৈশ্বিক টানাপোড়েনে পরিস্থিতি দ্রুত সংকটে গড়াতে পারে।

তিনি জানান, বর্তমানে ছয় থেকে আট মিলিয়ন টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। অথচ ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বা কোনো দেশের হঠাৎ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা- এসব কারণে খাদ্য আমদানি কঠিন হয়ে ওঠে। তাই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী রিজার্ভ, পর্যাপ্ত মজুত ও দ্রুত আমদানির সক্ষমতা অপরিহার্য।

উৎপাদন ও মজুত
কৃষিতে বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারের কথা উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে নেদারল্যান্ডসের মতো কৃষিতে প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন বাড়াতে হবে। নেদারল্যান্ডস ছোট দেশ হয়েও বছরে ১৩৩ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। বাংলাদেশেরও সীমিত জমিতে উৎপাদন দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু শুধু উৎপাদন বাড়লেই হবে না, ক্ষুদ্র কৃষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি। হঠাৎ বড় আকারে ফসল উঠলে দাম পড়ে যায় এবং কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। তাই প্রতিটি গ্রামে ছোট আকারে হিমাগার, আধুনিক সংরক্ষণব্যবস্থা, নতুন বাজার ও রপ্তানির সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।

কৃষি, রাজনীতি ও বৈশ্বিক বাণিজ্য একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। যেমন, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন সংকটের সময়ে বাংলাদেশ সয়াবিন আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী ফার্ম লবিকে বাংলাদেশের অনুকূলে এনেছে। এটি নতুন ধরনের বৈদেশিক নীতির কৌশল, উল্লেখ করেন শফিকুল আলম

আরও পড়ুন
মৎস্য ও প্রাণি সম্পদেও ভর্তুকি দরকার: ফরিদা আখতার
কৃষির আধুনিকায়নে আসছে ২৫ বছরের মহাপরিকল্পনা
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কাজ করছে সরকার: ফরিদা আখতার

মজুত সক্ষমতা বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে ২০ লাখ টন শস্য সংরক্ষণ করা হয়। এটি বাড়িয়ে ৫০ লাখ টনে নেওয়া উচিত। যাতে বৈশ্বিক সংকটের সময়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা যায়। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততার বিস্তার, জমির ব্যবহার কমে আসাসহ বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে নতুন জাত, নতুন প্রযুক্তি ও খাতভিত্তিক গবেষণা জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি।

কৃষিজমি রক্ষা
আবাসন বিস্তার করে কৃষিজমি নষ্ট করার প্রবণতার কঠোর সমালোচনা করেন প্রেস সচিব। তিনি বলেন, গ্রামের বাড়িঘর ফাঁকা পড়ে থাকা, কিন্তু কৃষিজমি ক্রমাগত কমে যাওয়া- এই বাস্তবতা মোকাবিলায় পরিকল্পিত গ্রাম উন্নয়ন জরুরি।

আমাদের ভবিষ্যৎ কৃষির বাইরে নয় উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, যে সরকার আসবে, যারাই নীতিনির্ধারক হোক, সবারই লক্ষ্য হওয়া উচিত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং কৃষিজমি ও কৃষককে সুরক্ষা দেওয়া। আমরা হয়তো নেদারল্যান্ডস হবো না কিন্তু লক্ষ্য রেখে ১০ বছর কাজ করলে অনেকটাই এগোনো সম্ভব।

বিপণনব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা
সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পার্টনার প্রোগ্রামের এজেন্সি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ও উপসচিব ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও বাজারসংযোগ দুর্বল এবং বিপণনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। পার্টনার প্রোগ্রামের ১০টি ডিএলআই বাস্তবায়নে সাতটি সরকারি সংস্থা যুক্ত হলেও সমন্বয় ঘাটতি রয়েছে। গ্যাপভিত্তিক নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, ভ্যালুচেইন প্রমোশনাল বডি গঠন এবং বাজারব্যবস্থা শক্তিশালী করার মাধ্যমে কৃষকের প্রকৃত লাভ নিশ্চিত করা এখন জরুরি।

এক্সপোর্ট অ্যান্ড প্রাইভেট সেক্টর কনসাল্টেন্ট ড. মো. মাহবুবুল আলম বলেন, পার্টনার প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারাদেশে ২০ হাজার কৃষি উদ্যোক্তা গড়ে তোলা হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, ইনকিউবেশন সাপোর্ট, সার্টিফিকেশন সহায়তা ও যন্ত্রপাতি কেনায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আসনের ৬০ শতাংশ সংরক্ষিত। আটটি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ এবং ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে উদ্যোক্তাদের ভ্যালুচেইনে প্রবেশ সহজ করা হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যের মাত্র পাঁচ ভাগ প্রক্রিয়াজাত হওয়ায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বড় সম্ভাবনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

প্রবন্ধ উপস্থাপনে পার্টনার প্রকল্পের (ডিএএম উইং) সিনিয়র মনিটরিং অফিসার মো. বায়েজিদ বোস্তামী বলেন, কৃষি ব্যবসায় যুবক ও নারীদের সম্পৃক্ত করে ২০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি এবং পাঁচটি প্রধান কৃষিপণ্যের ভ্যালুচেইন শক্তিশালী করার কাজ চলছে। আম, আলু, কাঁঠাল, টমেটো ও সুগন্ধি চাল- এই পাঁচ পণ্যে ভ্যালুচেইন প্রমোশনাল বডি গঠনের কাঠামো ও নীতিমালা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ৪২৬টি ম্যাপস ও ৬৬টি উপজেলা সংগঠন গঠিত হয়েছে। এসব কাঠামো উৎপাদক থেকে বাজার পর্যন্ত শক্তিশালী সংযোগ স্থাপন করবে এবং রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়াবে।

চারজনকে সম্মাননা
এসময় ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক ও বিএজেএফের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রিয়াজ আহমেদ, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও বিএজেএফের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রেজাউল করিম সিদ্দিক, বিএজেএফের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা স্ট্রিমের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক গোলাম ইফতেখার মাহমুদ এবং বর্তমান সভাপতি সাহানোয়ার সাঈদ শাহীনের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনে সহযোগী হিসেবে রয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

এমওএস/একিউএফ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।