বলিউডে যখন গ্ল্যামার, নাচগান আর মাংসপেশির প্রদর্শনীতে নায়কদের জনপ্রিয়তা মাপা হতো, তখনই এক মানুষ এসে দেখিয়ে দিলেন নায়কত্ব কেবল শরীরের নয়, মনের শক্তিতেও হয়। তিনি সানি দেওল। সংলাপে আগুন, চোখে দৃঢ়তা আর অভিনয়ে এক অনন্য বাস্তবতা-এই তিনেই তিনি জয় করেছেন দর্শকের মন।

পর্দায় তার উপস্থিতি যেন এক প্রতিজ্ঞার প্রতিধ্বনি-ন্যায়ের পক্ষে, আবেগের পক্ষে, মানুষের পক্ষে। তাই বলিউডের চকচকে দুনিয়ায়ও সানি দেওল আলাদা হয়ে থাকেন এক সরল অথচ দৃঢ় বার্তার কারণে-নায়ক হতে গেলে শুধু শক্তি নয়, চাই সত্যের প্রতি অটল বিশ্বাস।
বলিউডের অ্যাকশন জগতের এক অনন্য নাম সানি দেওল। আজ তার জন্মদিন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন একের পর এক স্মরণীয় সিনেমা, সংলাপ আর চরিত্র। তার শক্তিশালী উপস্থিতি, গভীর চোখ আর দৃঢ় কণ্ঠ বলিউডের পর্দায় এক সময় যেন অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। আজ যখন তিনি জীবনের ৬৮তম বছরে পা রাখছেন, তখন তার যাত্রাপথ ফিরে দেখা মানে বলিউডের এক যুগের ইতিহাসে ফিরে যাওয়া।

১৯৫৬ সালের এই দিনে পাঞ্জাবের লুধিয়ানার নিকটবর্তী শাহনেওয়াল গ্রামে জন্ম সানি দেওলের। তার প্রকৃত নাম অজয় সিং দেওল। পিতা ধর্মেন্দ্র ছিলেন তখনকার বলিউডের জনপ্রিয় নায়ক, আর মা প্রকাশ কউর ছিলেন এক সাধারণ গৃহিণী। এমন একটি পরিবারে জন্ম নেওয়া মানে একদিকে সুবিধা, অন্যদিকে বিশাল প্রত্যাশার বোঝা।

ছোটবেলা থেকেই সানি ছিলেন লাজুক, কিন্তু নিজের জগতে নিবিষ্ট। বাবার জনপ্রিয়তা তাকে কখনও দম্ভী করেনি, বরং অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে। অভিনয়ের প্রাথমিক শিক্ষা তিনি পান ইংল্যান্ডের ওল্ড রিপার্টরি থিয়েটারে। সেখান থেকেই অভিনয়ের কৌশল রপ্ত করে ফিরে আসেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে।

১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় সানি দেওলের প্রথম ছবি ‘বেতাব’। নতুন মুখ হিসেবে তার বিপরীতে ছিলেন আমৃতা সিং। ছবিটি ছিল তরুণ প্রেমের গল্প, কিন্তু এখানেই দর্শকরা টের পান-এই যুবকটি কেবল রোমান্টিক নায়ক হবেন না, তার চোখে আছে এক ধরনের তেজ ও দৃঢ়তা।

সেই তেজই পরবর্তী সময়ে তাকে এনে দেয় বলিউডের ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ খেতাব। ১৯৯০ সালের ‘ঘায়াল’ সিনেমায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক সাধারণ মানুষের লড়াই তাকে পৌঁছে দেয় ক্যারিয়ারের চূড়ায়। সেই ছবির জন্য তিনি পান ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, দুইই।

সানি দেওল মানেই যেন গর্জে ওঠা কণ্ঠ, ন্যায়বোধ আর বিস্ফোরক সংলাপ। তার সবচেয়ে বিখ্যাত সংলাপ, ‘ধাই কিলো কা হাত যখন কইয়ে পে পড়তা হ্যায়, তো আদমি উঠতা নহি, উঠ জাতা হ্যায়!’ এই সংলাপ শুধু বলিউডে নয়, ভারতীয় জনপ্রিয় সংস্কৃতির এক অমর অংশ হয়ে গেছে। সানির চরিত্রগুলো সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্বলদের পক্ষে-এই নৈতিক অবস্থানই তাকে দিয়েছে স্থায়ী জনপ্রিয়তা।

সানি দেওলের ক্যারিয়ার শুধু অ্যাকশনেই সীমাবদ্ধ নয়। তার ছবির তালিকায় আছে দেশপ্রেম, মানবতা ও ন্যায়বিচারের গল্প। ‘দামিনী’ (১৯৯৩) ছবিতে তিনি ছিলেন ন্যায়বিচারের পক্ষে লড়াই করা আইনজীবী। ‘তারিখ পে তারিখ’ সংলাপটি আজও সবার হৃদয়ে জায়গা দখল করে আছে।
‘বর্ডার’ (১৯৯৭)–এ তিনি এক সেনা অফিসার, যেখানে দেশপ্রেমে ভরপুর সংলাপ ও আবেগ দর্শককে নাড়া দিয়েছিল।

‘গদর: এক প্রেম কাহানি’ (২০০১) ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল সিনেমাগুলোর একটি, যেখানে প্রেম, দেশভাগ, আর সাহসের গল্প একাকার হয়ে গিয়েছিল। এই সিনেমাগুলো প্রমাণ করে, সানি দেওল শুধু বলিউডের হিরো নন-তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক সময়ের প্রতীক।
সানি দেওল শুধু ক্যামেরার সামনে নয়, ক্যামেরার পেছনেও নিজের দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। ১৯৯৯ সালে তিনি পরিচালনা করেন ‘দিল্লাগি’ সিনেমা, যেখানে অভিনয় করেন নিজের ভাই ববি দেওল ও উর্মিলা মাতোন্ডকারের সঙ্গে। ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা পায় এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করে একজন সংবেদনশীল নির্মাতা হিসেবে।

পরবর্তীতে ‘ঘায়াল ওয়ান্স এগেইন’, ‘পাল পাল দিল কে পাস’ ইত্যাদি সিনেমা প্রযোজনা ও পরিচালনার কাজও করেন তিনি।

২০১৯ সালে সানি দেওল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রার্থী হিসেবে পাঞ্জাবের গুরদাসপুর থেকে লোকসভা নির্বাচনে অংশ নেন এবং জয়লাভ করেন।

জনপ্রিয় অভিনেতা থেকে সংসদ সদস্যে রূপান্তর-এটিও ছিল তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। তবে রাজনীতিতেও তিনি বরাবরই সংযত, বেশি প্রচার নয়; বরং দায়িত্বের জায়গায় মনোযোগী থাকার চেষ্টা করেছেন।

সানি দেওলের ব্যক্তিজীবন বরাবরই ছিল নীরব ও গোপনীয়। স্ত্রী পূজা দেওল ও দুই ছেলে করণ ও রাজবীর-তাদের নিয়েই তার পৃথিবী। বড় ছেলে করণ এখন বলিউডে পা রেখেছেন, আর সানি সেই ভূমিকাতেও হয়েছেন পরামর্শদাতা পিতা।
তার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বড় দিক হলো বিনয়। আলোচনায় আসতে তিনি ভালোবাসেন না, কাজের মাধ্যমেই নিজের কথা বলাতে পছন্দ করেন।

যুগ বদলে গেছে। বলিউডে এসেছে নতুন মুখ, নতুন ধারা। তবু সানি দেওল এখনো দর্শকের কাছে সেই পুরোনো সাহসী হিরো। ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গদর ২’ ছবিও প্রমাণ করেছে, সানি এখনো বক্স অফিসে ঝড় তুলতে জানেন।

তার অভিনয়, সংলাপ এবং উপস্থিতি আজও এক প্রজন্মের নায়ককে মনে করিয়ে দেয়-যে লড়াই করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এবং বিশ্বাস করে ন্যায়ের জয়ে।
এডমিন 












