০৩:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, আল্লাহ আল্লাহ করি’

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ০৬:০১:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫
  • 17

সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার কৈডাঙ্গাসহ প্রায় ১৫টি গ্রামের মানুষের। গুমানী নদীর ওপর একটি সেতু না থাকায় একমাত্র রেল সেতু দিয়ে বছরের পর বছর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয় এসব গ্রামের অন্তত ২৫ হাজার মানুষকে। একই ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যায় শিশুরাও। দীর্ঘ সময় ধরে সংশ্লিষ্টদের এ ভোগান্তির কথা জানালেও আজও প্রতিকার মেলেনি ভুক্তভোগীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাঙ্গুড়া উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে গুমানী নদী। এ নদীর দুই পাড়ে কৈডাঙ্গা, নতুনপাড়া, পাঁচবেতুয়ান, বড়বেতুয়ান, বিলেরবাড়ী, চরভাঙ্গুড়া, এরশাদনগর, সুজা, চাচকিয়া, কালিয়াকৈর, পুইবিল, লক্ষ্মীকোল ও দিলপাশারসহ অন্তত ১৫টি গ্রাম রয়েছে। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া গুমানী নদী বর্ষায় একেবারে ভরা থাকে। শুষ্ক মৌসুমেও পানির কমতি থাকে না এ নদীতে। ফলে দুই পাড়ে যাতায়াত কখনোই সহজ নয়। দুই পাড়ের বাসিন্দাদেরই উভয় পাড়ে কৃষিকাজ, বাজার সদাই ও উপজেলা শহরসহ বিভিন্ন অফিসে যাতায়াতের জন্য এ নদী পার হতে হয়।

কিন্তু এ নদী পার হতে ভোগান্তির শেষ নেই। নেই কোনো সেতু। আছে শুধু খেয়া নৌকা ও একটি রেল সেতু। সন্ধ্যা হলেই খেয়া বন্ধ হয়। আবার দিনেও নৌকায় পারাপারে যাতায়াত খরচ বেড়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে রেল সেতু দিয়েই পারাপার হন স্কুলের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা। এতে যাতায়াতের সময় ট্রেন চলে এলে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। ট্রেন এলে কেউ পানিতে ঝাপ দেন, আবার কেউ আহত কিংবা নিহত হন।

সরেজমিনে কৈডাঙ্গা গ্রামের গুমানী নদীতে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল ছুটির পর রেল সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছে শিক্ষার্থীরা। একইভাবে পার হচ্ছেন স্থানীয় অন্যরাও। কেউ পার হচ্ছেন মাথায় বস্তা বা বোঝা নিয়ে। আবার কেউ পার হচ্ছেন বাচ্চা নিয়ে। ট্রেন এলে তাদের কী হবে- প্রয়োজনের তাগিদে সেটি যেন কারো মাথায় নেই। এমন সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা গেলো। রেল সেতুর মাঝ বরাবর ছিলেন এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি। ট্রেন আসাতে রেল সেতুর এক কোণে একটি পাতে কোনোমতে দাঁড়িয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন তিনি।

ট্রেন যাওয়ার পর তার পরিচয় জানা গেলো। তিনি কৈডাঙ্গা এলাকার শহিদ। নদী পারাপারের বিষয়ে জানতে চাইলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত আমাদের এভাবেই ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করতে হয়। উপায় নেই। এপার থেকে ওপারে দিনে অনেকবার যেতে হয়। কতবার খেয়া নৌকায় যাওয়া যায় বলেন? এতো টাকাইবা কোত্থেকে পাবো। তাই এভাবেই পারাপার হই। ঠান্ডা মাথায় আমার মতো কেউ কোণের পাতে দাঁড়াতে পারলে ভালো। না হলে হয় পানিতে ঝাপ দিতে হবে, না হয় মরতে হবে।

স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমারে চর ভাঙ্গুড়া, বেতুয়ান কৈডাঙ্গা সহকয়েকটি গ্রামের সবার ওই পাড়ে আবদি জমি। আমার প্রায় ৮ বিঘার মতো আবাদ। এসব জমির ফসল আনতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। সেই ভাঙ্গুড়া হয়ে নিম্নে ১০-১৫ কিলোমিটার ঘুরে আনতে হয়। কিন্তু এখানে একটা ব্রিজ হলে আর এ কষ্ট হয় না। নেতা বা অফিসারদের ধরলে খালি আশ্বাস দেয়, কিন্তু কেউ ব্রিজ দেয় না।’

বাচ্চা নিয়ে রেল সেতু পার হওয়া আমেনা খাতুন বলেন, ‘জানি রিস্ক আছে। কিন্তু কী করব। ভাঙ্গুড়া বাজারে যেতেই হবে। তাই রিস্ক নিয়ে আসতে হলো।’

খুরশিদা বেগম বলেন, ‘বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, তখন মনে ভয় নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আর আল্লাহ আল্লাহ করি। যেন এখনই ট্রেন না আসে। আবার বাচ্চারাও যেতে আসতে ভয় পায়। আামাদের এখানে বাড়ির জন্য না হয় রেল সেতু পার হবার সময় দাঁড়াই থাকি। কিন্তু অন্যান্য গ্রামের বাচ্চাদের ও তাদের মায়েদের কি অবস্থা? মনটা ভয়ে কাতর থাকে। আবার বাড়ির বেটা ছাওয়ালরা জমিতে যাওয়া আসা করে তখনও চিন্তার শেষ নাই।’

বেতুয়ান গ্রামের কোরবান আলী বলেন, রেল ব্রিজ দিয়ে পার হতে গিয়ে প্রতি বছর দু’চারজন কাটা পড়ে ও মারা যায়। আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারি না। নদীর ওপর যদি একটা ব্রিজ হতো তাহলে আমাদের উপকার হয়।

এ ব্যাপারে পাবনা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাদেকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গুমানী নদীর ওই পয়েন্টে কৈডাঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ও স্কুল রয়েছে। স্কুলের বাচ্চাসহ স্থানীয় বাসিন্দারা ঝুঁকি নিয়ে রেল ব্রিজ দিয়ে পার হন। ফলে মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে। এ বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। জনদুর্ভোগ কমাতে সেখানে একটি ব্রিজের প্রয়োজন রয়েছে। যেটি আমরা পরিকল্পনায় রেখেছি। ভবিষ্যতে যেকোনো প্রকল্পের আওতায় সেখানে একটি ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আলমগীর হোসাইন নাবিল/এফএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

ট্যাগঃ
জনপ্রিয় খবর

‘বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, আল্লাহ আল্লাহ করি’

আপডেট সময়ঃ ০৬:০১:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫

সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার কৈডাঙ্গাসহ প্রায় ১৫টি গ্রামের মানুষের। গুমানী নদীর ওপর একটি সেতু না থাকায় একমাত্র রেল সেতু দিয়ে বছরের পর বছর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয় এসব গ্রামের অন্তত ২৫ হাজার মানুষকে। একই ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যায় শিশুরাও। দীর্ঘ সময় ধরে সংশ্লিষ্টদের এ ভোগান্তির কথা জানালেও আজও প্রতিকার মেলেনি ভুক্তভোগীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাঙ্গুড়া উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে গুমানী নদী। এ নদীর দুই পাড়ে কৈডাঙ্গা, নতুনপাড়া, পাঁচবেতুয়ান, বড়বেতুয়ান, বিলেরবাড়ী, চরভাঙ্গুড়া, এরশাদনগর, সুজা, চাচকিয়া, কালিয়াকৈর, পুইবিল, লক্ষ্মীকোল ও দিলপাশারসহ অন্তত ১৫টি গ্রাম রয়েছে। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া গুমানী নদী বর্ষায় একেবারে ভরা থাকে। শুষ্ক মৌসুমেও পানির কমতি থাকে না এ নদীতে। ফলে দুই পাড়ে যাতায়াত কখনোই সহজ নয়। দুই পাড়ের বাসিন্দাদেরই উভয় পাড়ে কৃষিকাজ, বাজার সদাই ও উপজেলা শহরসহ বিভিন্ন অফিসে যাতায়াতের জন্য এ নদী পার হতে হয়।

কিন্তু এ নদী পার হতে ভোগান্তির শেষ নেই। নেই কোনো সেতু। আছে শুধু খেয়া নৌকা ও একটি রেল সেতু। সন্ধ্যা হলেই খেয়া বন্ধ হয়। আবার দিনেও নৌকায় পারাপারে যাতায়াত খরচ বেড়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে রেল সেতু দিয়েই পারাপার হন স্কুলের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা। এতে যাতায়াতের সময় ট্রেন চলে এলে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। ট্রেন এলে কেউ পানিতে ঝাপ দেন, আবার কেউ আহত কিংবা নিহত হন।

সরেজমিনে কৈডাঙ্গা গ্রামের গুমানী নদীতে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল ছুটির পর রেল সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছে শিক্ষার্থীরা। একইভাবে পার হচ্ছেন স্থানীয় অন্যরাও। কেউ পার হচ্ছেন মাথায় বস্তা বা বোঝা নিয়ে। আবার কেউ পার হচ্ছেন বাচ্চা নিয়ে। ট্রেন এলে তাদের কী হবে- প্রয়োজনের তাগিদে সেটি যেন কারো মাথায় নেই। এমন সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা গেলো। রেল সেতুর মাঝ বরাবর ছিলেন এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি। ট্রেন আসাতে রেল সেতুর এক কোণে একটি পাতে কোনোমতে দাঁড়িয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন তিনি।

ট্রেন যাওয়ার পর তার পরিচয় জানা গেলো। তিনি কৈডাঙ্গা এলাকার শহিদ। নদী পারাপারের বিষয়ে জানতে চাইলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত আমাদের এভাবেই ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করতে হয়। উপায় নেই। এপার থেকে ওপারে দিনে অনেকবার যেতে হয়। কতবার খেয়া নৌকায় যাওয়া যায় বলেন? এতো টাকাইবা কোত্থেকে পাবো। তাই এভাবেই পারাপার হই। ঠান্ডা মাথায় আমার মতো কেউ কোণের পাতে দাঁড়াতে পারলে ভালো। না হলে হয় পানিতে ঝাপ দিতে হবে, না হয় মরতে হবে।

স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমারে চর ভাঙ্গুড়া, বেতুয়ান কৈডাঙ্গা সহকয়েকটি গ্রামের সবার ওই পাড়ে আবদি জমি। আমার প্রায় ৮ বিঘার মতো আবাদ। এসব জমির ফসল আনতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। সেই ভাঙ্গুড়া হয়ে নিম্নে ১০-১৫ কিলোমিটার ঘুরে আনতে হয়। কিন্তু এখানে একটা ব্রিজ হলে আর এ কষ্ট হয় না। নেতা বা অফিসারদের ধরলে খালি আশ্বাস দেয়, কিন্তু কেউ ব্রিজ দেয় না।’

বাচ্চা নিয়ে রেল সেতু পার হওয়া আমেনা খাতুন বলেন, ‘জানি রিস্ক আছে। কিন্তু কী করব। ভাঙ্গুড়া বাজারে যেতেই হবে। তাই রিস্ক নিয়ে আসতে হলো।’

খুরশিদা বেগম বলেন, ‘বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, তখন মনে ভয় নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আর আল্লাহ আল্লাহ করি। যেন এখনই ট্রেন না আসে। আবার বাচ্চারাও যেতে আসতে ভয় পায়। আামাদের এখানে বাড়ির জন্য না হয় রেল সেতু পার হবার সময় দাঁড়াই থাকি। কিন্তু অন্যান্য গ্রামের বাচ্চাদের ও তাদের মায়েদের কি অবস্থা? মনটা ভয়ে কাতর থাকে। আবার বাড়ির বেটা ছাওয়ালরা জমিতে যাওয়া আসা করে তখনও চিন্তার শেষ নাই।’

বেতুয়ান গ্রামের কোরবান আলী বলেন, রেল ব্রিজ দিয়ে পার হতে গিয়ে প্রতি বছর দু’চারজন কাটা পড়ে ও মারা যায়। আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারি না। নদীর ওপর যদি একটা ব্রিজ হতো তাহলে আমাদের উপকার হয়।

এ ব্যাপারে পাবনা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাদেকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গুমানী নদীর ওই পয়েন্টে কৈডাঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ও স্কুল রয়েছে। স্কুলের বাচ্চাসহ স্থানীয় বাসিন্দারা ঝুঁকি নিয়ে রেল ব্রিজ দিয়ে পার হন। ফলে মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে। এ বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। জনদুর্ভোগ কমাতে সেখানে একটি ব্রিজের প্রয়োজন রয়েছে। যেটি আমরা পরিকল্পনায় রেখেছি। ভবিষ্যতে যেকোনো প্রকল্পের আওতায় সেখানে একটি ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আলমগীর হোসাইন নাবিল/এফএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।