০২:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বায়ুদূষণ ও তাপপ্রবাহ কি পুরুষের প্রজননক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে?

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ০৬:০৩:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৫
  • 1

বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান দূষণ, তাপপ্রবাহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এক নতুন বিপদের ইঙ্গিত মিলছে। গত কয়েক দশকের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণমান ক্রমাগত কমছে, যা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, ধূমপান বা মানসিক চাপের মতো জীবনযাপনের কারণগুলো ছাড়াও এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশগত কারণ—বিশেষ করে বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পুরুষদের প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলছে।

ভারতের ফোর্টিস এসকর্টস হাসপাতালের গাইনোকোলজি ও অবস্টেট্রিকস বিভাগের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. নিটি কৌশিশ পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা কেবল ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি পৃথিবীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের প্রতিফলন।

তিনি বলেন, বিশ্ব যখন উষ্ণতর ও নগরায়িত হচ্ছে, তখন এই লুকিয়ে থাকা হুমকিগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং মোকাবিলা করা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।

ভারতে বায়ুদূষণ দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসযন্ত্র ও হৃদরোগের অন্যতম কারণ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রমাণ দেখাচ্ছে, এটি পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতাকেও নষ্ট করছে।

ডা. কৌশিশ ব্যাখ্যা করেন, বায়ুদূষণের সূক্ষ্ম কণিকা (পিএম২.৫) ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (এনও২)-এর মতো বিষাক্ত গ্যাস শরীরে প্রবেশ করে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি করে, যা শুক্রাণুর ডিএনএ নষ্ট করে ও হরমোনের ভারসাম্য ব্যাহত করে।

২০২২ সালে এনভাইরোনমেন্টাল হেল্থ পারসপেক্টিভ-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, পিএম২.৫এর উচ্চ মাত্রার সংস্পর্শে আসলে শুক্রাণুর গতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। চীন ও ইতালির গবেষণাতেও দেখা গেছে, দূষিত শহরে বসবাসকারী পুরুষদের শুক্রাণুগুণমান গ্রামীণ এলাকার পুরুষদের তুলনায় ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম।

বায়ুদূষণ যেমন শুক্রাণুর গঠন নষ্ট করে, তেমনি অতিরিক্ত তাপমাত্রাও শুক্রাণু উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে।

ডা. কৌশিশ বলেন, বীর্যাশয় শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা ঠান্ডা পরিবেশে ভালো কাজ করে। কিন্তু গ্লোবাল ওয়ার্মিং, গরম পরিবেশে কাজ করা, বা টাইট পোশাক পরার ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যা শুক্রাণু উৎপাদন ব্যাহত করে।

জার্নাল অব থার্মালোজি-এর গবেষণায় দেখা গেছে, টেস্টিকুলার তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে শুক্রাণু উৎপাদন ও গতিশীলতা প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়।

কারখানা, নির্মাণক্ষেত্র বা ফাউন্ড্রিতে কাজ করা শ্রমিকরা বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে আছেন। ২০২৪ সালে ভারতের ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর রেকর্ডসংখ্যক তাপপ্রবাহের দিন নথিভুক্ত করেছে, যেখানে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে।

ডা. কৌশিশ সতর্ক করেন, এমন তাপমাত্রা এখন আর বিরল নয়। দীর্ঘমেয়াদী তাপপ্রবাহ শুক্রাণুর ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করে ও প্রজননক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

দূষণ ও তাপের সম্মিলিত প্রভাব ভয়াবহ উল্লেখ করে ডা. কৌশিশ বলেন, শহরগুলো যত গরম ও দূষিত হচ্ছে, পুরুষদের প্রজননক্ষমতা তত ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

ভারতের দ্রুত নগরায়িত অঞ্চলে এই দুই বিপদ একসঙ্গে দেখা দিচ্ছে। ২০২৩ সালে আইসিএমআর-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দূষণ ও তাপপ্রবাহের মধ্যে দীর্ঘ সময় থাকা পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণুর ডিএনএ ক্ষতি ও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

গবেষকরা এটিকে বলছেন এনভাইরনমেন্টাল ইনফারটিলিটি লুপ— যেখানে পরিবেশগত সংকট সরাসরি প্রজননস্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়।

কীভাবে রক্ষা করা যায় পুরুষদের প্রজননক্ষমতা

ডা. কৌশিশের পরামর্শ: তাপপ্রবাহের সময় দীর্ঘ সময় গরমে না থাকা, ঢিলেঢালা ও বাতাস চলাচলকারী পোশাক পরা, পর্যাপ্ত পানি পান ও বিশ্রাম নেওয়া, ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল পরিহার করা, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার—ফল, সবজি, বাদাম ও বীজ—খাওয়া।

তিনি বলেন, যেসব পেশায় পুরুষদের গরমে কাজ করতে হয়, যেমন নির্মাণ বা কারখানা, সেখানে ঠান্ডা বিরতি, পর্যাপ্ত পানি ও সুরক্ষামূলক পোশাকের ব্যবস্থা থাকা উচিত।”

ডা. কৌশিশের মতে, সরকারকে বায়ুগুণমান নিয়ন্ত্রণ, সবুজ নগর পরিকল্পনা ও তাপ প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নিতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, পুরুষদের প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে, কারণ এটি শুধু স্বাস্থ্য নয়—আমাদের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন।”

সূত্র: এনডিটিভি

এমএসএম

ট্যাগঃ

বায়ুদূষণ ও তাপপ্রবাহ কি পুরুষের প্রজননক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে?

আপডেট সময়ঃ ০৬:০৩:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৫

বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান দূষণ, তাপপ্রবাহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এক নতুন বিপদের ইঙ্গিত মিলছে। গত কয়েক দশকের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণমান ক্রমাগত কমছে, যা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, ধূমপান বা মানসিক চাপের মতো জীবনযাপনের কারণগুলো ছাড়াও এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশগত কারণ—বিশেষ করে বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পুরুষদের প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলছে।

ভারতের ফোর্টিস এসকর্টস হাসপাতালের গাইনোকোলজি ও অবস্টেট্রিকস বিভাগের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. নিটি কৌশিশ পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা কেবল ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি পৃথিবীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের প্রতিফলন।

তিনি বলেন, বিশ্ব যখন উষ্ণতর ও নগরায়িত হচ্ছে, তখন এই লুকিয়ে থাকা হুমকিগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং মোকাবিলা করা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।

ভারতে বায়ুদূষণ দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসযন্ত্র ও হৃদরোগের অন্যতম কারণ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রমাণ দেখাচ্ছে, এটি পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতাকেও নষ্ট করছে।

ডা. কৌশিশ ব্যাখ্যা করেন, বায়ুদূষণের সূক্ষ্ম কণিকা (পিএম২.৫) ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (এনও২)-এর মতো বিষাক্ত গ্যাস শরীরে প্রবেশ করে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি করে, যা শুক্রাণুর ডিএনএ নষ্ট করে ও হরমোনের ভারসাম্য ব্যাহত করে।

২০২২ সালে এনভাইরোনমেন্টাল হেল্থ পারসপেক্টিভ-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, পিএম২.৫এর উচ্চ মাত্রার সংস্পর্শে আসলে শুক্রাণুর গতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। চীন ও ইতালির গবেষণাতেও দেখা গেছে, দূষিত শহরে বসবাসকারী পুরুষদের শুক্রাণুগুণমান গ্রামীণ এলাকার পুরুষদের তুলনায় ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম।

বায়ুদূষণ যেমন শুক্রাণুর গঠন নষ্ট করে, তেমনি অতিরিক্ত তাপমাত্রাও শুক্রাণু উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে।

ডা. কৌশিশ বলেন, বীর্যাশয় শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা ঠান্ডা পরিবেশে ভালো কাজ করে। কিন্তু গ্লোবাল ওয়ার্মিং, গরম পরিবেশে কাজ করা, বা টাইট পোশাক পরার ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যা শুক্রাণু উৎপাদন ব্যাহত করে।

জার্নাল অব থার্মালোজি-এর গবেষণায় দেখা গেছে, টেস্টিকুলার তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে শুক্রাণু উৎপাদন ও গতিশীলতা প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়।

কারখানা, নির্মাণক্ষেত্র বা ফাউন্ড্রিতে কাজ করা শ্রমিকরা বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে আছেন। ২০২৪ সালে ভারতের ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর রেকর্ডসংখ্যক তাপপ্রবাহের দিন নথিভুক্ত করেছে, যেখানে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে।

ডা. কৌশিশ সতর্ক করেন, এমন তাপমাত্রা এখন আর বিরল নয়। দীর্ঘমেয়াদী তাপপ্রবাহ শুক্রাণুর ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করে ও প্রজননক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

দূষণ ও তাপের সম্মিলিত প্রভাব ভয়াবহ উল্লেখ করে ডা. কৌশিশ বলেন, শহরগুলো যত গরম ও দূষিত হচ্ছে, পুরুষদের প্রজননক্ষমতা তত ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

ভারতের দ্রুত নগরায়িত অঞ্চলে এই দুই বিপদ একসঙ্গে দেখা দিচ্ছে। ২০২৩ সালে আইসিএমআর-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দূষণ ও তাপপ্রবাহের মধ্যে দীর্ঘ সময় থাকা পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণুর ডিএনএ ক্ষতি ও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

গবেষকরা এটিকে বলছেন এনভাইরনমেন্টাল ইনফারটিলিটি লুপ— যেখানে পরিবেশগত সংকট সরাসরি প্রজননস্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়।

কীভাবে রক্ষা করা যায় পুরুষদের প্রজননক্ষমতা

ডা. কৌশিশের পরামর্শ: তাপপ্রবাহের সময় দীর্ঘ সময় গরমে না থাকা, ঢিলেঢালা ও বাতাস চলাচলকারী পোশাক পরা, পর্যাপ্ত পানি পান ও বিশ্রাম নেওয়া, ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল পরিহার করা, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার—ফল, সবজি, বাদাম ও বীজ—খাওয়া।

তিনি বলেন, যেসব পেশায় পুরুষদের গরমে কাজ করতে হয়, যেমন নির্মাণ বা কারখানা, সেখানে ঠান্ডা বিরতি, পর্যাপ্ত পানি ও সুরক্ষামূলক পোশাকের ব্যবস্থা থাকা উচিত।”

ডা. কৌশিশের মতে, সরকারকে বায়ুগুণমান নিয়ন্ত্রণ, সবুজ নগর পরিকল্পনা ও তাপ প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নিতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, পুরুষদের প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে, কারণ এটি শুধু স্বাস্থ্য নয়—আমাদের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন।”

সূত্র: এনডিটিভি

এমএসএম