দেশে যে কোনো পণ্যের ব্যবসা করতে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) লাইসেন্স নিতে হয়। এই লাইসেন্স নিতে দিতে হয় আবেদন, টেস্ট ফিসহ নানা ধরনের ফি। তবে ব্যবসায়ীদের বেশি ভোগায় ‘সার্টিফিকেশন মার্ক ফি’, যা পণ্যের উৎপাদন বা বিক্রির ওপর প্রতি বছর হিসাবে দিতে হয়।
পণ্যের লাইসেন্স পেতে ঘুস-হয়রানির অভিযোগ রয়েছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। এত এত ফির চাপে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। লোকসানের মুখে প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি এতে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণ।
বেশ কয়েকজন ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পণ্য ও সেবার মান প্রণয়নকারী এ প্রতিষ্ঠান নানান কৌশলে নিচ্ছে অতিরিক্ত ফি। বেশকিছু ফি অযৌক্তিক হারে নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ফির হার বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, শুরুতে পণ্যের লাইসেন্স দিতে সমস্যা করে বিএসটিআই। এরপর আবেদন ও উচ্চ লাইসেন্স ফি আদায় করে। পাশাপাশি লাইসেন্স দেওয়ার পর প্রতি বছর সার্টিফিকেশন মার্ক ফি বাবদ বার্ষিক বিক্রির ওপর বিশেষ পারসেন্টেজ নিয়ে কোম্পানিগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা নিচ্ছে সংস্থাটি। এই টাকা সরকারি কোষাগারে নয়, জমা হয় বিএসটিআইর নিজস্ব তহবিলে।
বিএসটিআইর ফিগুলো অনেক বেশি। যে কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণে সমস্যা হয়। আবার আমরা অন্য দেশে পণ্য রপ্তানি করি, সেসব দেশে কিন্তু বাংলাদেশের বিএসটিআইর মতো নানান ধরনের ফি দিতে হয় না। এজন্য আমরা বিভিন্ন সময় দাবি করে আসছি এসব ফি সমন্বয় করার জন্য।- স্কয়ার ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা পারভেজ সাইফুল ইসলাম
তেজগাঁওয়ে বিএসটিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ের সামনে জাগো নিউজের প্রতিবেদকের কথা হয় লাইসেন্স নিতে ও নবায়ন করতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে। জিহাদুল ইসলাম নামে একজন প্রতিষ্ঠানের নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘এক ধরনের জুলুম করে বিএসটিআই নানা ধরনের ফি নিচ্ছে। শুরুতে আবেদন ফি নেওয়া হয় এক হাজার টাকা। এটা কেন? কাগজ-কলমে আবেদন করতে কেন এত টাকা? এরপর টেস্টের নামে পণ্যভেদে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘এরপর বিএসটিআই এমন নিয়ম করেছে যে প্রতিটি ক্যাটাগরির প্রতিটি সাইজ ও ধরনভেদে আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে। অর্থাৎ, একটি বিস্কুট মিষ্টি হলে আলাদা, নোনতা হলে আলাদা, চানাচুর ঝাল হলে আলাদা, মিষ্টি, বারবিকিউ হলে আলাদা। আবার প্যাকেটের সাইজ ১০০, ২৫০, ৫০০ গ্রাম হলে আলাদা। এটা কী ধরনের জুলুম!’
আরও পড়ুন
খুঁড়িয়ে চলছে ৬ হাজার কোটি টাকার রং শিল্প
সার কারখানায় গ্যাসের দাম ১৫০% বাড়াতে চায় কেন সরকার?
বেশি সুদে আমানত টানছে দুর্বল ব্যাংক, বাড়ছে ঝুঁকি
৬০০ কোটি টাকার মেরিন পেইন্টের বাজারে বাধা শুল্ক-করের বোঝা
মিম ফুড প্রোডাক্টর্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ইয়াকুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তিন ধরনের চানাচুর চারটি সাইজে বাজারজাত করতে চাই। এখন তারা (বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ) বলছে ১২টি আলাদা আবেদন করতে। প্রতিটির ফি ও টেস্ট ফি আলাদা। এটা অন্যায়।’
সার্টিফিকেট মার্ক ফি কমানোর বিষয়টি আমাদের সক্রিয় বিবেচনায় আছে। এটি বিএসটিআইর আইনে নির্ধারিত, সেটা কমাতে আমরা কাজ করছি।- বিএসটিআইর পরিচালক (প্রশাসন) মো. নূরুল আমিন
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবেদন করার পর বিএসটিআইকে প্রতিটি পণ্যের জন্য আলাদা আলাদা স্যাম্পল দিতে হয়। এই স্যাম্পল টেস্টের জন্য দিতে হয় পণ্যভেদে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বিদ্যুৎ হোসেন নামের এক উদ্যোক্তা বলেন, ‘শুধু একটি চাটনির জন্য লাইসেন্স নিতে এসে দেখি এর জন্য ৭ হাজার ৩৫০ টাকা টেস্ট ফি ও সঙ্গে এক হাজার টাকা আবেদন ফি দিতে হবে। এরপর তিন ধরনের চাটনির জন্য আলাদা আলাদা আবেদন করতে হবে, ফিও আলাদা। অর্থাৎ, ২৫ হাজার টাকার মতো যাবে আবেদন করতেই। এটি আমার মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য জুলুম। এরপরও লাইসেন্স পাবো কি না জানি না।’
লাইসেন্সের চেয়েও বড় জুলুম ‘সার্টিফিকেশন মার্ক ফি’
বিভিন্ন খরচ ও জটিলতায় পণ্য বিএসটিআইর মানের লাইসেন্স পাওয়ার পরে উদ্যোক্তারা পড়েন আরও বড় বিপদে। লাইসেন্স টিকিয়ে রাখতে তাদের বছরের পর বছর ব্যয় করতে হয় কাড়ি কাড়ি অর্থ। যেটা পণ্যের সার্টিফিকেশন মার্ক ফি বাবদ। তিন বছর পরপর মান সনদ নবায়নে এ টাকা দিতে হয় প্রতি বছরের হিসাবে।
কোনো পণ্য বিএসটিআইর লাইসেন্স পাওয়ার পর সেই পণ্যের বার্ষিক উৎপাদন বা বিক্রির ওপর দশমিক ০৭ থেকে দশমিক ১০ শতাংশ হারে প্রতি বছর সার্টিফিকেশন মার্ক ফি দিতে হয়। অর্থাৎ তিন বছর পর নবায়নের সময় প্রতি বছরের আলাদা আলাদা ফি হিসেবে প্রতি পণ্যের বিক্রির ওপরে দশমিক ০৭ থেকে দশমিক ১০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় উদ্যোক্তাদের। এর সঙ্গে আবার যোগ হয় ১৫ শতাংশ ভ্যাট।
যেখানে দেশে ৮০ শতাংশ বিনিয়োগ অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে, সেখানে বিনিয়োগ আগ্রহী করতে সেভাবে আইনের সহজীকরণ দরকার। একটি ব্যবসাবান্ধব নীতি দরকার।- ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ
স্কয়ার ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা পারভেজ সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএসটিআইর ফিগুলো অনেক বেশি। যে কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণে সমস্যা হয়। আবার আমরা অন্য দেশে পণ্য রপ্তানি করি, সেসব দেশে কিন্তু বাংলাদেশের বিএসটিআইর মতো নানা ধরনের ফি দিতে হয় না। এজন্য আমরা বিভিন্ন সময় দাবি করে আসছি এসব ফি সমন্বয় করার জন্য।’
জানা যায়, বিএসটিআইর ৩১৫টি বাধ্যতামূলক পণ্যের আওতায় ১৩ হাজার লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান এই ফি দিচ্ছে প্রতি বছর, যা বিএসটিআইয়ের আয়ের একটি প্রধান উৎস। এই সুযোগে বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
মার্কিং ফি শূন্য দশমিক ০৭ শতাংশ হারে বার্ষিক সর্বনিম্ন ১২৫০ টাকা ও বার্ষিক সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা এবং শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক সর্বনিম্ন ১৮৭৫ টাকা ও বার্ষিক সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্যের যদি কোনো ফি নেওয়াই হয় তবে সেটা লাভের ওপর হতে পারে। যারা ব্যবসায় লোকসান করছেন তাদের জন্য এ ফি ক্ষতিকর। কিন্তু বিএসটিআই কৌশলে সেটি বিক্রির ওপর করেছে। এতে যদি একটি পণ্য ১৫০ কোটি টাকা বিক্রি হয় তবে তার জন্য দিতে হবে বছরে ১৫ লাখ টাকা। বিএসটিআই এভাবে ১৩ হাজার পণ্যের লাইসেন্সের সার্টিফিকেট মার্ক ফি বাবদ প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএসটিআইর পরিচালক (প্রশাসন) মো. নূরুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সার্টিফিকেট মার্ক ফি কমানোর বিষয়টি আমাদের সক্রিয় বিবেচনায় আছে। এটি বিএসটিআইর আইনে নির্ধারিত, সেটা কমাতে আমরা কাজ করছি।’
এদিকে ফির এসব টাকা সরকারি কোষাগারে নয়, বিএসটিআইর নিজস্ব তহবিলে জমা হচ্ছে, যা তাদের কর্মচারীরা কৌশলে ভোগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএসটিআইর তথ্যে জানা যায়, গত অর্থবছর সংস্থাটি নবায়ন ফির বড় আয়সহ মোট ২০৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা আয় করেছে।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে খরচ বেশি
জাগো নিউজের কথা হয় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে, যিনি কোম্পানিটির দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে প্রতিনিধিত্ব করেন। তবে তিনি পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভারত, পাকিস্তান, নেপালের চেয়ে বাংলাদেশে পণ্যের লাইসেন্স নবায়নসহ অন্য সব ফি বেশি। যে কারণে বাংলাদেশে পণ্য বৈচিত্র্য কম। ব্যবসায় খরচ বেশি। এটি বাংলাদেশের সহজে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।’
ব্যবসায়ীরা জানান, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে নবায়ন ফি নির্ধারিত নেই। অন্য ফি পণ্যের ধরন ও ব্যবসার আকারের ওপর নির্ধারিত হয়, যা সব স্তরের ব্যবসায়ীদের জন্য স্বস্তিদায়ক। এসব ফি অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে এককালীন। কিন্তু বাংলাদেশে এ ফি প্রতি বছর নেওয়া হচ্ছে।
খরচ বেশি বলে অনেকে লাইসেন্স নেন না, নিয়েও ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে
অধিকাংশ নতুন উদ্যোক্তা ব্যবসার শুরুতে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করার পরে লাইসেন্স নিয়ে যখন পণ্য বাজারজাত করেন, তারপর তারা নানা ফির চাপে বিপদে পড়েন। তারপরেও পুরো বিক্রির জন্য বিএসটিআইকে টাকা দিতে গিয়ে লোকসান গুনছেন। এতে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন।
এসব চাপ থেকে বাঁচতে অনেকে বিএসটিআইর লাইসেন্স ছাড়া পণ্য বিক্রি করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নিজস্ব ব্যবস্থায় একক ক্যাটাগরিতে পণ্য টেস্ট করে সেই ব্র্যান্ডকে বাজারজাত করার সনদ দেয় সহজে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেখানে দেশে ৮০ শতাংশ বিনিয়োগ অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে, সেখানে বিনিয়োগ আগ্রহী করতে সেভাবে আইনের সহজীকরণ দরকার। একটি ব্যবসাবান্ধব নীতি দরকার।’
তিনি বলেন, ‘এ দেশে একটি ব্যবসা শুরু করতে রেগুলেশন, স্টার্টআপ ও কমপ্লায়েন্স- এ তিন ধরনের পেপারওয়ার্ক করতে হয়। আমার মনে হয়, ব্যবসায়ীদের রেগুলেটরি ছাড়া অন্য বিষয়ে কিছুটা শিথিল, বিশেষ করে কমপ্লায়েন্সের জন্য একটি নির্ধারিত সময় দেওয়া দরকার। আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মুনাফা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান চালানোর এ মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।’
শামস মাহমুদ বলেন, ‘নীতি-আইন সহজ হলে সবাই আইন মানতে চাইবে। চাপিয়ে দিলে সেটা কঠিন হয়, ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে।’
এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/এএসএম
এডমিন 













