রংপুর নগরীর সিগারেট কোম্পানি এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগম। জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন মাছ কাটার কাজ। এ পথেই কেটে গেছে ৩৩ বছর। প্রতিদিনি সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে সংসারের টুকিটাকি কাজ শেষ করে চলে আসেন সিটি বাজারে। সারাদিন মাছ কেটে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে সংসারের খরচ।
একই বাজারে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ কাটার কাজ করছেন আমাশু কুকরুল এলাকার বাসিন্দা শেফালী বেগমও।
সিটি বাজারে মরিয়ম ও শেফালীর মতো নানা বয়সি প্রায় অর্ধশত নারী এ পেশায় যুক্ত। যাদের মধ্যে অনেকই বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা অভাবের সংসার চালাতে এ পেশায় এসেছেন। উনুনের খড় পোড়ানো ছাই আর ধারালো বটি দিয়ে মাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।
ছোট পরিবার আর ব্যস্ততম সময়ের মাঝে ঝামেলা এড়াতে বাজারেই ছোট-বড় মাছ কেটে নেন ক্রেতারাও। এতে দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে মাছকাটা।
আরও পড়ুন
লোকলজ্জা উপেক্ষা, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান সুলতানা
গৃহপরিচারিকা থেকে চা দোকানি—জুয়ায় নিঃস্ব সবাই
কথা হয় সিটি বাজারে মাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করা মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। মরিয়ম বেগম জানান, অভাবের সংসারে হাল ধরতে আজ থেকে ৩২-৩৩ বছর আগে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন মাছ কাটার কাজ। একটা সময় ২-৪ জন এ পেশায় নিয়োজিত থাকলেও দিন বদলের ধারায় এখন যুক্ত হয়েছেন অন্তত পঞ্চাশ জনের মতো নারী। এক কেজি ছোট মাছ ৩০ টাকা ও বড় মাছ ২০ টাকা করে দাম নির্ধারণ করা থাকলেও অনেকেই তা দেন না। এখন দৈনিক মাছ কেটে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। এর থেকে জায়গা ভাড়া, ইজারা, পানির বিল ও ময়লা পরিষ্কার বাবদ প্রায় ১০০ টাকা দিতে হয় বাজার কর্তৃপক্ষকে। খরচ বাদে যা থাকে তা দিয়েই চলে সংসারের খরচ। তবে আগের তুলনায় এখন আয় অনেক কমে গেছে।

মরিয়ম আরও জানান, মাছ কাটার কাজ করা নারীদের সংখ্যা বাড়ায় প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এতে কমেছে আয়। যতদিন শরীর কুলায় ঠিক ততদিন কাজ চালিয়ে যেতে চান।
এ পেশার আরে নারী শেফালী বেগমকে কতদিন ধরে কাজ করছেন, জানতে চাইলে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে হাতের আঙ্গুলে হিসাব গুণতে গুণতে বলেন, ‘এই হবে হয়ত ১০-১২ বছর। কাজ না করে আর উপায় কী? একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত যায় না।’
ষাটোর্ধ্ব রাবেয়া বেগম নামের এক নারী জানান, বাজারে মানুষের মাছ কেটে পরিবার চালানোর পাশাপাশি মেয়ের বিয়ে ও নাতি-নাতনির পড়াশোনা খরচ চালাতে হয়। এছাড়া নিজের চিকিৎসায় প্রতিদিন ১০০-১৫০ টাকার ওষুধও কিনতে হয়। প্রতিদিন যে আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকমে দিন চলে যায়।
স্থায়ী কোনো জায়গার ব্যবস্থা ও প্রতিদিন ভাড়া বাবদ ১০০ টাকার মতো যে টাকা দেওয়া লাগে তা যদি মওকুফ হতো তাহলে আরও ভালো হতো, এমনটাই বলেন মর্জিনা বেগম নামে আরেক নারী।
ফরিদা বেগম নামে আরেক বলেন, অল্প বয়সে বিয়ে হয়। দুই বছর না যেতেই স্বামী ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকে এই বাজারে মাছ কাটাকাটির কাজ শুরু। মাছ কেটে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে দিন।
ওই বাজারে টেংরা মাছ কিনে কাটতে দিয়েছেন নগরীর মেডিকেল পূর্ব গেট এলাকার আলম মিয়া নামে এক ব্যক্তি।
আরও পড়ুন
শখের বশে শোপিস তৈরি, মাসে আয় লাখ টাকা
সংকটে শাঁখা শিল্প, পেশা বদলাচ্ছেন কারিগররা
আলম মিয়া বলেন, ছোট মাছ যাদের প্রিয় তাদের ভরসা এই নারীরা। বাড়িতে মাছ কাটার ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে এখানে প্রতিনিয়ত আসেন। এতে প্রতি কেজি মাছে তার অতিরিক্ত ১৫-২০ টাকা খরচ হয়। তারা মাছ কেটে দিচ্ছে বলেই ছোট মাছের স্বাদ নিতে পারছি।
আলমগীর হোসেন নামে আরেকজন ক্রেতা বলেন, তাদের এই পেশাটা অনেক ভালো। তারাও আয় করে সংসার চালাচ্ছেন আমাদেরও সুবিধা হচ্ছে।
রংপুর সিটি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য মনির বলেন, বাজারে প্রায় অর্ধশত নারী মাছ কেটে সংসার চালাচ্ছেন। যাদের মধ্যে অনেকেই ২৫-৩০ বছর ধরে কাজ করছেন। অনেকে এ পেশায় থেকে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে পেরেছেন। তারা এ কাজে সম্পৃক্ত আছেন বলে ক্রেতারাও উপকৃত হচ্ছেন। আমরাও তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করছি।
জিতু কবীর/এমএন/জিকেএস
এডমিন 















