পুঁজিবাজারের সম্ভাবনার চেয়ে সমস্যাই বেশি এবং এই সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে নৈতিক অবক্ষয়, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও পরিকল্পিত লুটপাট। আমাদের পুঁজিবাজারে বছরের পর বছর যা ঘটেছে, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে সংঘটিত পুঁজি লুট। এমন মন্তব্য করেছেন ফেলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (এফসিএ) মাহমুদ হোসেন।
শনিবার (৪ অক্টোবর) জাগোনিউজ২৪.কম আয়োজিত ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাগোনিউজ২৪.কম এর সম্পাদক কে. এম. জিয়াউল হক এবং সঞ্চালনা করেন ডেপুটি চিফ রিপোর্টার সাঈদ শিপন।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কর্তৃক গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য মো. আল-আমিন, পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন, প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের এমডি ও সিইও মনিরুজ্জামান, হিসাববিদ মাহমুদ হোসেন (এফসিএ) এবং ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল এনালিস্ট মো. মামুনুর রশীদ।
মাহমুদ হোসেন (এফসিএ) বলেন, আমাদের দেশে বিনিয়োগকারীরা শুধু মুনাফা থেকেই বঞ্চিত হন না, বরং নিজেদের পুঁজিরও নিরাপত্তা পান না। যেখানে আইনের শাসন নেই, সেখানে বিনিয়োগ নিরাপদ থাকা অসম্ভব।
স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই বলে মন্তব্য করেন মাহমুদ হোসেন। তিনি বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড আসলে হয়ে উঠেছে আনক্লেইমড ডিভিডেন্ডের ওপর এফডিআর করে সুদ খাওয়ার প্ল্যাটফর্ম। এই ফান্ড থেকে বাজারে কত টাকা বিনিয়োগ হয়েছে? কোনো রেগুলেটর বা মিডিয়া কি সেই তথ্য প্রকাশ করেছে?
পুঁজিবাজারে রাজনৈতিক বন্দোবস্তে পুঁজি লুট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে বছরের পর বছর যা ঘটেছে, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে সংঘটিত পুঁজি লুট।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, সুকুক বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডেও একই ধরনের অস্বচ্ছতা। কোথাও কোনো স্বচ্ছ রিপোর্ট নেই।
মূলধন সংগ্রহ এখনো কঠিন জানিয়ে তিনি বলেন, পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ এখনো একটি দীর্ঘসূত্র ও জটিল প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া অনেক সহজ। তাই নতুন কোম্পানিগুলো বাজারে আসতেই চায় না।

আস্থাহীনতার গভীর সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কথা ও কাজে অমিল থাকলে আস্থা ফিরবে না। ক্রেতা, বিক্রেতা ও রেগুলেটর- তিন পক্ষের মধ্যে যখন বিশ্বাসের অভাব থাকে, তখন বাজার কখনোই স্থিতিশীল হতে পারে না।
আরও পড়ুন
১৪ মাসে পোর্টফোলিও অর্ধেকে, আস্থা ফেরেনি বিনিয়োগকারীদের
পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে এজিএম, অডিট মান ও তথ্যের স্বচ্ছতা জরুরি
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অডিটর-ইস্যু ম্যানেজার-প্রভাবশালীদের ‘আনহলি নেক্সাস’ তৈরি হয়েছে। আজকাল বাজারে অনেক কোম্পানি আসে মূলধন সংগ্রহ নয়, বরং উদ্যোক্তাদের সম্পদ বাড়াতে। ইস্যু ম্যানেজাররা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রজেকশন দেখায়, আর কিছু অডিট ফার্ম সেই মিথ্যা প্রজেকশনকে ‘সমর্থন’ দেয়। এভাবেই তৈরি হয় একটি ‘আনহলি নেক্সাস’। অডিটর, ইস্যু ম্যানেজার ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী মিলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করছে।
তিনি বলেন, অডিটরদের স্বাধীনতা নেই। একজন অডিটর হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি স্বচ্ছ রিপোর্ট দিলে কনট্রাক্ট বাতিল হয়। এফআরসি বা আইসিএবি কেউই অডিটরদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে না। ফলে পেশাদারত্বও হুমকির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রায় সব রেগুলেটরি সংস্থার কার্যকারিতা ভেঙে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেখানে গভর্নর নিজেই কোনো স্কিমে বিনিয়োগ না করতে সিইওকে ধমক দেন সেখানে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কিন্তু কয়টি মামলা হয়েছে? কয়টি তদন্ত হয়েছে? এই লুটপাট ছিল পরিকল্পিত। কিন্তু রাজনৈতিক আপসে দুর্নীতিবাজরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মাহমুদ হোসেন বলেন, সকালে প্রতিবাদে নামি, বিকেলে ফুলের টব চুরি করি এটাই আমাদের নৈতিক কাঠামো। এই চরিত্রগত সংকট না বদলালে কাগুজে সংস্কার দিয়ে কোনো লাভ নেই। ইমাম বাটনের মতো প্রকল্পে প্রভাবশালী পরিচালক ও কমিশনভোগী কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। আমাকে সেখানকার পরিচালক করা হয়েছিল, কিন্তু আমি দায়িত্ব নেইনি, কারণ জানতাম সেখানে সৎ থাকা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, তবে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই হতে পারে না। আমাদের চরিত্র বদলাতে হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং যারা লুটপাটে অংশ নিয়েছে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই ফিরবে আস্থা, আর পুঁজিবাজার চলবে টেকসই পথে।
গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাগোনিউজ২৪.কম এর প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল, ডেপুটি এডিটর ড. হারুন রশীদ, চিফ রিপোর্টার ইব্রাহিম হোসেন অভি, নিউজ এডিটর মাহবুব আলম রনি প্রমুখ।
ইএআর/এএমএ/জেআইএম
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।
এডমিন 













