০৭:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংযোগ হারিয়ে অচল সাতক্ষীরার নদীপথ

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ০৬:০১:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • 15

২৭টি নদীর মধ্যে নাব্যতা হারিয়েছে অন্তত ১৩টি
গাবুরা-খুলনা রুটে চলাচল করছে একমাত্র লঞ্চ
জোয়ারের পানিতে আসা পলি জমে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী-খাল
অর্থনীতি চাঙা করতে নৌরুট সচলের দাবি ব্যবসায়ীদের

এক সময়ের প্রাণবন্ত নদীবিধৌত জেলা সাতক্ষীরার নৌপথ আজ অচলপ্রায়। বেতনা, মরিচ্চাপ, ইছামতি কিংবা কপোতাক্ষ সবখানেই নীরবতা। জেলার ২৭টি নদীর মধ্যে অন্তত ১৩টি এরইমধ্যে নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায়, অস্তিত্ব সংকটে শত শত খালও। অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ, নিয়মিত খননের অভাব আর জলবায়ু পরিবর্তনে অচল সাতক্ষীরার নৌরুটগুলো। তবুও যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের শেষ ভরসা হয়ে এখনো চলছে গাবুরা-খুলনা রুটের একমাত্র লঞ্চটি।

নদীর ঘাটে নীরবতা

এক সময় জমজমাট ছিল মরিচ্চাপ, বেতনা, কপোতাক্ষসহ সাতক্ষীরার নদীগুলো। নৌঘাটগুলোতে লেগে থাকত যাত্রী-ব্যবসায়ীর ভিড়। এখন অনেক নদীঘাট নিশ্চুপ, কোথাও কোথাও চর পড়ে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র গাবুরা-খুলনা রুটে চলাচল করা নৌযানটি চলছে এখনও। এটি উপকূলের যাত্রীদের জন্য আরামদায়ক, পণ্য পরিবহনেও সাশ্রয়ী। প্রতিদিন বিকেল ৪টায় গাবুরা ঘাট থেকে ছাড়ে লঞ্চটি, খুলনায় পৌঁছায় নিরাপদে।

গাবুরার বাসিন্দা রবিউল হোসেন বলেন, নদীপথে খরচ কম, আবার আরামেও যাওয়া যায়। সড়ক পথে খরচ বেশি পড়ে। তবে একটি লঞ্চ যথেষ্ট নয়, আরও লঞ্চ চালু হলে আমরা উপকৃত হতাম।

স্থানীয় বাসিন্দা হাসানুর গাজী জানান, চাল, ডাল, তেল, সব পণ্য নদীপথে আনলে খরচ অনেক কম হয়। এখন একমাত্র লঞ্চটাই ভরসা। বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আরও সমস্যায় পড়বো।

শিক্ষক ফিরোজা বেগম বলেন, সড়ক পথে গাবুরা থেকে সাতক্ষীরা হয়ে খুলনা যেতে ৬০০-৭০০ টাকা গাড়িভাড়া খরচ হয়। কিন্তু লঞ্চে ২০০ টাকা হয়, যাত্রাও নিরাপদ।

‘চাল, ডাল, তেল, সব পণ্য নদীপথে আনলে খরচ অনেক কম হয়। এখন একমাত্র লঞ্চটাই ভরসা। বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আরও সমস্যায় পড়বো।’

যাত্রী কমেছে, খরচ ওঠে না

গাবুরা-খুলনা রুটে চলাচলকারী একমাত্র লঞ্চের ম্যানেজার বাবুল চৌধুরি জানান, এই রুটে এখন আর আগের মতো যাত্রী নেই। তাছাড়া নদীতে অনেক স্থানে চর পড়েছে। ভাটির সময় লঞ্চ আটকে যায়। আবহাওয়া খারাপ থাকলে যাত্রীর অভাবে অনেক সময় তেল খরচই ওঠে না। তবুও রুট পারমিট ঠিক রাখতে প্রতিদিন নিয়মিত চলাচল করছে লঞ্চ।

তিনি বলেন, আগে লঞ্চটি নীলডুমুর ঘাট পর্যন্ত যেতে পারত। কিন্তু চৌদ্দরোশি এলাকায় একটি ব্রিজ নির্মাণ হওয়ার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

আরও পড়ুন-

চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌপথ খননে ব্যয় বাড়লো ১২ কোটি টাকা
চিলমারী-রৌমারী নৌরুটে স্বস্তি
‘হাবুডুবু’ খাচ্ছে ৩ হাজার কোটি টাকার নৌরুট উন্নয়ন কাজ

ঘাট মালিক রবিউল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন যাত্রী পাওয়া যায় না, একটা লঞ্চ চালাতেই কষ্ট হয়। গাবুরা ঘাট থেকে গড়ে ৩০ থেকে ৭০ জন যাত্রী ওঠানামা করে। পুরো রুটে মোট ১৮টি ঘাট আছে, প্রতিটি ঘাট থেকেই কমবেশি যাত্রী চলাচল করে। যাত্রীসংখ্যা খুব বেশি না হলেও রুটটি সচল আছে বলেই এলাকার মানুষ অন্তত কিছুটা হলেও সুবিধা পাচ্ছে। শুধু যাত্রী নয়, এখানকার ঘেরে চাষ হওয়া মাছ খুলনায় যায় এই রুট দিয়েই। পাশাপাশি সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত মধু, মাছ আর কাঁকড়া পরিবহনেও এই নৌপথ ব্যবহার করা হয়। তাই এ রুট সচল থাকা স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সংযোগ হারিয়ে অচল সাতক্ষীরার নদীপথ

ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ

গাবুরার ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের বলেন, নদীপথে মাল আনতে খরচ তিন ভাগ কম লাগে। কিন্তু সড়কপথে একই পণ্য তিনগুণ বেশি দিয়ে আনতে হয়। এতে আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাধ্য হয়ে পণ্যের দাম বাড়াতে হচ্ছে, আর শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।

‘এই রুটে এখন আর আগের মতো যাত্রী নেই। তাছাড়া নদীতে অনেক স্থানে চর পড়েছে। ভাটির সময় লঞ্চ আটকে যায়। আবহাওয়া খারাপ থাকলে যাত্রীর অভাবে অনেক সময় তেল খরচই ওঠে না। তবুও রুট পারমিট ঠিক রাখতে প্রতিদিন নিয়মিত চলাচল করছে লঞ্চ।’

খুলনার পাইকারি ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম জানান, নৌপথ সচল না থাকায় পরিবহন খরচ প্রতিদিন বাড়ছে। ট্রাকে মাছ, মধু বা কাঁকড়া আনার খরচ দ্বিগুণেরও বেশি। এতে শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, পুরো স্থানীয় অর্থনীতিই চাপে পড়ছে।

শ্যামনগরের মাছ ব্যবসায়ী শহিদুল গাজী বলেন, আগে নদীপথে খুলনায় মাছ পাঠাতে খরচ হতো খুব কম। এখন সড়কপথে পাঠাতে গেলে খরচ এত বেড়ে যায় যে লাভ তো হয়ই না, উল্টো লোকসান গুনতে হচ্ছে। ফলে অনেকেই মাছ বিক্রি করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন।

নদী হারাচ্ছে অস্তিত্ব

পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাতক্ষীরার ২৭টি নদীর মধ্যে অন্তত ১৩টি এরইমধ্যেই পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া ৪২৯টি খালও অস্তিত্ব সংকটে। নাব্যতা হারানোয় শুধু নৌচলাচল বন্ধ হচ্ছে না, জলাবদ্ধতা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিও বাড়ছে।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা স্বদেশের নির্বাহী পরিচালক মাধব দত্ত জাগো নিউজকে বলেন, নদী খনন ও সচল রুট থাকলে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা হবে, পরিবেশও রক্ষা পাবে। নদীভিত্তিক যোগাযোগ শুধু ঐতিহ্য নয়, এটি টেকসই সমাধান। কিন্তু এই অঞ্চলের নদ নদীর সঙ্গে এখন আর উজানের নদ নদীর কোনো সংযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষায় অতিবৃষ্টি ও শুষ্ক মৌসুমে দীর্ঘ খরার প্রভাবে নদীগুলো অস্বাভাবিকভাবে ভরাট হয়ে পড়ছে। ফলে সাগরের জোয়ারের পানিতে আসা অতিরিক্ত পলি জমে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী ও খাল। এতে জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, গ্রামীণ জীবিকা ও কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাই নদী খনন, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন একসঙ্গে না হলে সংকট আরও তীব্র হবে।

সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাতক্ষীরার উপকূল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে নোনা পানি ভেতরে ঢুকছে, অন্যদিকে অতিবৃষ্টি আর ঘূর্ণিঝড়ে embankment ভেঙে নদীগুলোতে ভয়াবহ চাপ তৈরি হচ্ছে। এতে একদিকে নদী ভরাট হচ্ছে, অন্যদিকে নৌপথ অচল হয়ে পড়ছে। নৌপথ সচল থাকলে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, দুর্যোগকালীন ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রমেও বড় সুবিধা পাওয়া যেত। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও অব্যবস্থাপনার কারণে এখন নদী-খাল হারিয়ে যাচ্ছে, আর এর খেসারত দিচ্ছে উপকূলের মানুষ।

সংযোগ হারিয়ে অচল সাতক্ষীরার নদীপথ

সরকারি উদ্যোগ কী?

বিআইডব্লিউটিএ খুলনা নদী বন্দরের উপ-পরিচালক মোহা. মাসুদ পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কিছু নির্দিষ্ট রুটে ড্রেজিংয়ের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সাতক্ষীরার কয়েকটি নৌরুট চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো বরাদ্দ ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে সব রুট সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষায় অতিবৃষ্টি ও শুষ্ক মৌসুমে দীর্ঘ খরার প্রভাবে নদীগুলো অস্বাভাবিকভাবে ভরাট হয়ে পড়ছে। ফলে সাগরের জোয়ারের পানিতে আসা অতিরিক্ত পলি জমে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী ও খাল। এতে জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, গ্রামীণ জীবিকা ও কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাই নদী খনন, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন একসঙ্গে না হলে সংকট আরও তীব্র হবে।’

তিনি বলেন, নদীগুলোতে অতিরিক্ত পলি জমা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং স্থানীয় দখলদারিত্বের ফলে নাব্যতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শুধু ড্রেজিং করলেই হবে না, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নদী সচল থাকলে শুধু নৌযান চলাচলই নয়, বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা কমবে, পরিবেশ সুরক্ষা পাবে এবং স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙা হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও টেকসই বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন।

সাতক্ষীরার নদীগুলো শুধু যোগাযোগ ও ব্যবসার বাহন ছিল না, এ অঞ্চলকে দিয়েছে আলাদা প্রাণশক্তি। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই ঐতিহ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতও বাড়াচ্ছে সংকট। তবু এখনো সময় আছে। পরিকল্পিত নদী খনন, দূরদর্শী সেতু নির্মাণ আর কার্যকর নৌপথ ব্যবস্থাপনায় বদলে যেতে পারে চিত্র। নদীভিত্তিক যোগাযোগ শুধু ইতিহাস নয়, হতে পারে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা আর জনসচেতনতা।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।

ট্যাগঃ

সংযোগ হারিয়ে অচল সাতক্ষীরার নদীপথ

আপডেট সময়ঃ ০৬:০১:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

২৭টি নদীর মধ্যে নাব্যতা হারিয়েছে অন্তত ১৩টি
গাবুরা-খুলনা রুটে চলাচল করছে একমাত্র লঞ্চ
জোয়ারের পানিতে আসা পলি জমে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী-খাল
অর্থনীতি চাঙা করতে নৌরুট সচলের দাবি ব্যবসায়ীদের

এক সময়ের প্রাণবন্ত নদীবিধৌত জেলা সাতক্ষীরার নৌপথ আজ অচলপ্রায়। বেতনা, মরিচ্চাপ, ইছামতি কিংবা কপোতাক্ষ সবখানেই নীরবতা। জেলার ২৭টি নদীর মধ্যে অন্তত ১৩টি এরইমধ্যে নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায়, অস্তিত্ব সংকটে শত শত খালও। অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ, নিয়মিত খননের অভাব আর জলবায়ু পরিবর্তনে অচল সাতক্ষীরার নৌরুটগুলো। তবুও যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের শেষ ভরসা হয়ে এখনো চলছে গাবুরা-খুলনা রুটের একমাত্র লঞ্চটি।

নদীর ঘাটে নীরবতা

এক সময় জমজমাট ছিল মরিচ্চাপ, বেতনা, কপোতাক্ষসহ সাতক্ষীরার নদীগুলো। নৌঘাটগুলোতে লেগে থাকত যাত্রী-ব্যবসায়ীর ভিড়। এখন অনেক নদীঘাট নিশ্চুপ, কোথাও কোথাও চর পড়ে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র গাবুরা-খুলনা রুটে চলাচল করা নৌযানটি চলছে এখনও। এটি উপকূলের যাত্রীদের জন্য আরামদায়ক, পণ্য পরিবহনেও সাশ্রয়ী। প্রতিদিন বিকেল ৪টায় গাবুরা ঘাট থেকে ছাড়ে লঞ্চটি, খুলনায় পৌঁছায় নিরাপদে।

গাবুরার বাসিন্দা রবিউল হোসেন বলেন, নদীপথে খরচ কম, আবার আরামেও যাওয়া যায়। সড়ক পথে খরচ বেশি পড়ে। তবে একটি লঞ্চ যথেষ্ট নয়, আরও লঞ্চ চালু হলে আমরা উপকৃত হতাম।

স্থানীয় বাসিন্দা হাসানুর গাজী জানান, চাল, ডাল, তেল, সব পণ্য নদীপথে আনলে খরচ অনেক কম হয়। এখন একমাত্র লঞ্চটাই ভরসা। বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আরও সমস্যায় পড়বো।

শিক্ষক ফিরোজা বেগম বলেন, সড়ক পথে গাবুরা থেকে সাতক্ষীরা হয়ে খুলনা যেতে ৬০০-৭০০ টাকা গাড়িভাড়া খরচ হয়। কিন্তু লঞ্চে ২০০ টাকা হয়, যাত্রাও নিরাপদ।

‘চাল, ডাল, তেল, সব পণ্য নদীপথে আনলে খরচ অনেক কম হয়। এখন একমাত্র লঞ্চটাই ভরসা। বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আরও সমস্যায় পড়বো।’

যাত্রী কমেছে, খরচ ওঠে না

গাবুরা-খুলনা রুটে চলাচলকারী একমাত্র লঞ্চের ম্যানেজার বাবুল চৌধুরি জানান, এই রুটে এখন আর আগের মতো যাত্রী নেই। তাছাড়া নদীতে অনেক স্থানে চর পড়েছে। ভাটির সময় লঞ্চ আটকে যায়। আবহাওয়া খারাপ থাকলে যাত্রীর অভাবে অনেক সময় তেল খরচই ওঠে না। তবুও রুট পারমিট ঠিক রাখতে প্রতিদিন নিয়মিত চলাচল করছে লঞ্চ।

তিনি বলেন, আগে লঞ্চটি নীলডুমুর ঘাট পর্যন্ত যেতে পারত। কিন্তু চৌদ্দরোশি এলাকায় একটি ব্রিজ নির্মাণ হওয়ার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

আরও পড়ুন-

চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌপথ খননে ব্যয় বাড়লো ১২ কোটি টাকা
চিলমারী-রৌমারী নৌরুটে স্বস্তি
‘হাবুডুবু’ খাচ্ছে ৩ হাজার কোটি টাকার নৌরুট উন্নয়ন কাজ

ঘাট মালিক রবিউল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন যাত্রী পাওয়া যায় না, একটা লঞ্চ চালাতেই কষ্ট হয়। গাবুরা ঘাট থেকে গড়ে ৩০ থেকে ৭০ জন যাত্রী ওঠানামা করে। পুরো রুটে মোট ১৮টি ঘাট আছে, প্রতিটি ঘাট থেকেই কমবেশি যাত্রী চলাচল করে। যাত্রীসংখ্যা খুব বেশি না হলেও রুটটি সচল আছে বলেই এলাকার মানুষ অন্তত কিছুটা হলেও সুবিধা পাচ্ছে। শুধু যাত্রী নয়, এখানকার ঘেরে চাষ হওয়া মাছ খুলনায় যায় এই রুট দিয়েই। পাশাপাশি সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত মধু, মাছ আর কাঁকড়া পরিবহনেও এই নৌপথ ব্যবহার করা হয়। তাই এ রুট সচল থাকা স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সংযোগ হারিয়ে অচল সাতক্ষীরার নদীপথ

ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ

গাবুরার ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের বলেন, নদীপথে মাল আনতে খরচ তিন ভাগ কম লাগে। কিন্তু সড়কপথে একই পণ্য তিনগুণ বেশি দিয়ে আনতে হয়। এতে আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাধ্য হয়ে পণ্যের দাম বাড়াতে হচ্ছে, আর শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।

‘এই রুটে এখন আর আগের মতো যাত্রী নেই। তাছাড়া নদীতে অনেক স্থানে চর পড়েছে। ভাটির সময় লঞ্চ আটকে যায়। আবহাওয়া খারাপ থাকলে যাত্রীর অভাবে অনেক সময় তেল খরচই ওঠে না। তবুও রুট পারমিট ঠিক রাখতে প্রতিদিন নিয়মিত চলাচল করছে লঞ্চ।’

খুলনার পাইকারি ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম জানান, নৌপথ সচল না থাকায় পরিবহন খরচ প্রতিদিন বাড়ছে। ট্রাকে মাছ, মধু বা কাঁকড়া আনার খরচ দ্বিগুণেরও বেশি। এতে শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, পুরো স্থানীয় অর্থনীতিই চাপে পড়ছে।

শ্যামনগরের মাছ ব্যবসায়ী শহিদুল গাজী বলেন, আগে নদীপথে খুলনায় মাছ পাঠাতে খরচ হতো খুব কম। এখন সড়কপথে পাঠাতে গেলে খরচ এত বেড়ে যায় যে লাভ তো হয়ই না, উল্টো লোকসান গুনতে হচ্ছে। ফলে অনেকেই মাছ বিক্রি করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন।

নদী হারাচ্ছে অস্তিত্ব

পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাতক্ষীরার ২৭টি নদীর মধ্যে অন্তত ১৩টি এরইমধ্যেই পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া ৪২৯টি খালও অস্তিত্ব সংকটে। নাব্যতা হারানোয় শুধু নৌচলাচল বন্ধ হচ্ছে না, জলাবদ্ধতা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিও বাড়ছে।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা স্বদেশের নির্বাহী পরিচালক মাধব দত্ত জাগো নিউজকে বলেন, নদী খনন ও সচল রুট থাকলে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা হবে, পরিবেশও রক্ষা পাবে। নদীভিত্তিক যোগাযোগ শুধু ঐতিহ্য নয়, এটি টেকসই সমাধান। কিন্তু এই অঞ্চলের নদ নদীর সঙ্গে এখন আর উজানের নদ নদীর কোনো সংযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষায় অতিবৃষ্টি ও শুষ্ক মৌসুমে দীর্ঘ খরার প্রভাবে নদীগুলো অস্বাভাবিকভাবে ভরাট হয়ে পড়ছে। ফলে সাগরের জোয়ারের পানিতে আসা অতিরিক্ত পলি জমে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী ও খাল। এতে জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, গ্রামীণ জীবিকা ও কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাই নদী খনন, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন একসঙ্গে না হলে সংকট আরও তীব্র হবে।

সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাতক্ষীরার উপকূল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে নোনা পানি ভেতরে ঢুকছে, অন্যদিকে অতিবৃষ্টি আর ঘূর্ণিঝড়ে embankment ভেঙে নদীগুলোতে ভয়াবহ চাপ তৈরি হচ্ছে। এতে একদিকে নদী ভরাট হচ্ছে, অন্যদিকে নৌপথ অচল হয়ে পড়ছে। নৌপথ সচল থাকলে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, দুর্যোগকালীন ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রমেও বড় সুবিধা পাওয়া যেত। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও অব্যবস্থাপনার কারণে এখন নদী-খাল হারিয়ে যাচ্ছে, আর এর খেসারত দিচ্ছে উপকূলের মানুষ।

সংযোগ হারিয়ে অচল সাতক্ষীরার নদীপথ

সরকারি উদ্যোগ কী?

বিআইডব্লিউটিএ খুলনা নদী বন্দরের উপ-পরিচালক মোহা. মাসুদ পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কিছু নির্দিষ্ট রুটে ড্রেজিংয়ের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সাতক্ষীরার কয়েকটি নৌরুট চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো বরাদ্দ ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে সব রুট সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষায় অতিবৃষ্টি ও শুষ্ক মৌসুমে দীর্ঘ খরার প্রভাবে নদীগুলো অস্বাভাবিকভাবে ভরাট হয়ে পড়ছে। ফলে সাগরের জোয়ারের পানিতে আসা অতিরিক্ত পলি জমে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী ও খাল। এতে জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, গ্রামীণ জীবিকা ও কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাই নদী খনন, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন একসঙ্গে না হলে সংকট আরও তীব্র হবে।’

তিনি বলেন, নদীগুলোতে অতিরিক্ত পলি জমা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং স্থানীয় দখলদারিত্বের ফলে নাব্যতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শুধু ড্রেজিং করলেই হবে না, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নদী সচল থাকলে শুধু নৌযান চলাচলই নয়, বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা কমবে, পরিবেশ সুরক্ষা পাবে এবং স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙা হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও টেকসই বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন।

সাতক্ষীরার নদীগুলো শুধু যোগাযোগ ও ব্যবসার বাহন ছিল না, এ অঞ্চলকে দিয়েছে আলাদা প্রাণশক্তি। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই ঐতিহ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতও বাড়াচ্ছে সংকট। তবু এখনো সময় আছে। পরিকল্পিত নদী খনন, দূরদর্শী সেতু নির্মাণ আর কার্যকর নৌপথ ব্যবস্থাপনায় বদলে যেতে পারে চিত্র। নদীভিত্তিক যোগাযোগ শুধু ইতিহাস নয়, হতে পারে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা আর জনসচেতনতা।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।