১২:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ২২ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

স্কলারশিপ পেলেও বাংলাদেশে আসতে পারছেন না ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ০৬:০২:৩২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ অগাস্ট ২০২৫
  • 57

মাহা আদনান শাবাইর। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের শিক্ষার্থী। ফুল স্কলারশিপে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। চলতি শিক্ষাবর্ষে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ বিষয়ে মাস্টার্স করার জন্য পূর্ণ স্কলারশিপ পেয়েছেন। একই সঙ্গে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগও দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু স্কলারশিপের সেই সুযোগ নিতে গাজা ছেড়ে বাংলাদেশ আসতে পারছেন না মাহা। ফিলিস্তিনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। তাই বাংলাদেশের ভিসা সংগ্রহ করতে হলে তাকে পার্শ্ববর্তী দেশ জর্ডানের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে স্ব-শরীরে আবেদন করতে হবে।

বর্তমানে আমরা প্রায় ৮০ জন ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়ালেখা করছি। তবে বর্ডার ইস্যুর কারণে গত বছর ২২০ জন ফিলিস্তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়েও আসতে পারেনি।–শিক্ষার্থী বাদউই আহমেদ

গাজায় কোনো বিমানবন্দর নেই, আর চারপাশের সব সীমান্ত ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে থাকায় সরাসরি জর্ডানে যাওয়া মাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখনো ই-ভিসাও চালু করা হয়নি।

ফলে একদিকে নিজ দেশে চলমান যুদ্ধ, প্রাণহানি ও অনিশ্চয়তার ভয়, অন্যদিকে বহু কষ্টে অর্জিত স্কলারশিপ হারানোর আশঙ্কা—এই দুই বিপরীত বাস্তবতার মধ্যেই দিন কাটছে মাহার।

মাহার মতো অনেক শিক্ষার্থীই প্রতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফুল স্কলারশিপে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ফুল স্কলারশিপ ও চাকরির অফার পেয়েও শুধু দূতাবাসের সহযোগিতা না পাওয়ায় সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারছি না। অন্য অনেক দেশের দূতাবাস তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের সমন্বয় করে আসছে।–শিক্ষার্থী মাহা আদনান শাবাইর

বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষার্থে আসা ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের সংগঠন জেনারেল ইউনিয়ন অব প্যালেস্টাইন স্টুডেন্ট ইন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্র বাদউই আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা প্রায় ৮০ জন ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়ালেখা করছি। তবে বর্ডার ইস্যুর কারণে গত বছর ২২০ জন ফিলিস্তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়েও আসতে পারেনি।’

তবে এবছর ফিলিস্তিনের কতজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ স্কলারশিপ পেয়েছেন সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নন বলেন জানান বাদউই আহমেদ।

বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ফলে তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের সুযোগ নেই। ভিসা অন-অ্যারাইভালের সুযোগ আছে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা পান। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেটা দেয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই অ্যাপ্রুভাল নিতে পারে।- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম

জানা যায়, গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের (কেবল ছাত্র, পরিবার এবং রোগীদের) বের হওয়ার একমাত্র পথ এখন ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা কারেম আবু সালেম ক্রসিং। তবে এর জন্য তাদের কাছে সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা থাকতে হবে এবং ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বের হওয়ার অনুমতি পেতে হবে।

ফলে এখন জরুরি প্রয়োজন ও বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া কোনো ফিলিস্তিনির পক্ষে দেশ ছাড়ার সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে গাজা থেকে বের হওয়ার জন্য গন্তব্য দেশের দূতাবাসগুলোকেই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। তবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না।

দক্ষিণ গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে জাগো নিউজকে মাহা জানান, ফিলিস্তিনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস না থাকায় সাধারণত জর্ডান ও মিশরে অবস্থিত দূতাবাসগুলো এসব কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করে।

বাংলাদেশ কখনো ফিলিস্তিনিদের ভিসা দিতে সমস্যা করেনি। প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদার সেনাবাহিনী, যারা রাফা সীমান্ত দিয়ে ফিলিস্তিনিদের মিশরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। বর্তমানে রাফা সীমান্ত পুরোপুরি ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।- বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান

‘গাজার একমাত্র চলাচলের পথ কেরেম আবু সালেম সীমান্ত, যা জর্ডানের দিকে। তাই আমি জর্ডানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে সহযোগিতার জন্য ইমেইল করি। আমি তাদের জানাই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র পাওয়া ছাড়া গাজা ছাড়ার কোনো উপায় নেই, আর সে অনুমতির জন্য দূতাবাসের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলেই দূতাবাসে সরাসরি উপস্থিত হয়ে ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবো।’ বলেন মাহা।

তবে দূতাবাস এ ধরনের সহায়তা করতে অপরাগ বলে জানিয়েছে। আর এটাই মাহাদের মতো বাংলাদেশে স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্রদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘এ ধরনের সমন্বয় ছাড়া আমি বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌঁছাতে পারছি না, কার্যত আমরা বন্দি অবস্থায় আছি।’ বলেন মাহা।

স্কলারশিপ পেলেও বাংলাদেশে আসতে পারছেন না ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা

‘বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ফুল স্কলারশিপ ও চাকরির অফার পেয়েও শুধু দূতাবাসের সহযোগিতা না পাওয়ায় সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘অন্য অনেক দেশের দূতাবাস তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের সমন্বয় করে আসছে। আমার এক বন্ধু সম্প্রতি ফ্রান্স থেকে মাস্টার্স স্কলারশিপ পেয়েছে। ফ্রান্সের দূতাবাস তার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি আদায় করে গাজা ছাড়তে সহায়তা করেছে।’

মাহার আকুতি, ‘আমি চাই, বাংলাদেশ দূতাবাসও আমাদের পাশে দাঁড়াক, যেমনটা অন্য দেশের দূতাবাসগুলো করছে।’

কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই ইসরায়েলের সঙ্গে

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ফলে তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের সুযোগ নেই। ভিসা অন-অ্যারাইভালের সুযোগ আছে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা পান। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেটা দেয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই অ্যাপ্রুভাল নিতে পারে।’

তবে ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশের দূতাবাস ফিলিস্তিনের শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের গাজা থেকে নিরাপদে বের করে নিয়ে গেছে। দূতাবাসগুলো বিকল্প হিসেবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর, এমএসএফ কিংবা মিশর ও জর্ডানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতির সঙ্গেও সামঞ্জস্য রেখে ফিলিস্তিনের নাগরিকদের জন্য দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

এদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ কখনো ফিলিস্তিনিদের ভিসা দিতে সমস্যা করেনি। প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদার সেনাবাহিনী, যারা রাফা সীমান্ত দিয়ে ফিলিস্তিনিদের মিশরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। বর্তমানে রাফা সীমান্ত পুরোপুরি ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।’

‘আমরা কাউকে ইসরায়েলি গেট দিয়ে গাজা ছাড়ার পরামর্শ দিই না। কারণ, যারা সে পথ দিয়ে গাজা ছাড়ে, তাদের আর ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয় না। এটি ইসরায়েলের একটি পরিকল্পিত কৌশল—ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে চিরতরে সরিয়ে দিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের বসানো। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তার চরমপন্থি সরকার প্রকাশ্যেই এ নীতিকে সমর্থন করেছে।’

স্কলারশিপ পেলেও বাংলাদেশে আসতে পারছেন না ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা

রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সব সময় ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবির পক্ষে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক রীতিনীতি শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসরণ করে আসছে।’

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা তিনটি প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভক্ত। উত্তর গাজা অঞ্চলে রয়েছে বেইত হানউন, বেইত লাহিয়া ও জাবালিয়া শহর। এ অঞ্চলটি ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত এরেজ ক্রসিংয়ের কাছাকাছি অবস্থিত।

মধ্য গাজা এলাকায় রয়েছে নুসেইরাত, দেইর আল-বালাহ, মাঘাজি ও বুরেইজ। এখানে বহু শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছে, যেখানে যুদ্ধ ও মানবিক সংকটের চিহ্ন আরও প্রকট।

দক্ষিণ গাজা অঞ্চলে রয়েছে খান ইউনুস ও রাফাহ, যা গাজার অন্যতম বৃহৎ শহর। এ অংশটি কেরেম আবু সালেম ক্রসিংয়ের সন্নিকটে অবস্থিত।

ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা জানান, কেরেম আবু সালেম ক্রসিং দিয়ে গাজা ছাড়ার পর জর্ডানে পৌঁছাতে হলে ইসরায়েল হয়ে ট্রানজিট নিতে হয়। এই যাত্রাপথ সাধারণত পশ্চিম তীর (ওয়েস্ট ব্যাংক) অতিক্রম করে এবং শেষ হয় জর্ডান সীমান্তে অবস্থিত আলেনবি ব্রিজে (কিং হুসেইন ক্রসিং নামেও পরিচিত)।

দিন কাটছে মৃত্যু আর ধ্বংসের মাঝে

গাজার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ, আর দিনে দিনে তা আরও খারাপ হচ্ছে—বলছিলেন মাহা।

তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতিদিনই মৃত্যু, ধ্বংস, বোমা হামলা আর গোলাবর্ষণ চলছে। কোনো দিন শান্তিপূর্ণভাবে কাটছে না।’

এখন মাহা একসঙ্গে আছেন তার বাবা-মা, ছোট ভাই, বোন, বোনের স্বামী ও তাদের ছোট সন্তান, খালা ও খালাতো দুই বোনকে নিয়ে।

মাহা জানান, সবশেষ মে মাসে তারা নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

‘এই নিয়ে ছয়বার পালাতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু এবার আর ফেরার উপায় নেই, কারণ আমাদের বাড়ি একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে একটি ইসরায়েলি বিমান হামলায়।’ বলেন মাহা।

‘আমরা কখনো তাদের ক্ষমা করবো না—যারা নিজেদের মুসলিম বলে, অথচ গাজায় আমাদের ওপর চলা নিপীড়নের সময় চুপ থাকে। এই ভয়, ক্ষুধা আর হারানোর যন্ত্রণা তাদের নীরবতারও দায়,’ বলেন মাহা।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আইহাও আলইয়ামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে এখানে মেডিকেল কলেজে পড়তে পারছি। এজন্য আমরা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানি না। আমার পরিবার ফিলিস্তিনে আছে, তবে এমন পরিস্থিতে যেখানে এক সপ্তাহের পরিকল্পনাও তারা করতে পারে না।’

জেপিআই/এএসএ/এমএফএজিকেএস

ট্যাগঃ

স্কলারশিপ পেলেও বাংলাদেশে আসতে পারছেন না ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা

আপডেট সময়ঃ ০৬:০২:৩২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ অগাস্ট ২০২৫

মাহা আদনান শাবাইর। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের শিক্ষার্থী। ফুল স্কলারশিপে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। চলতি শিক্ষাবর্ষে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ বিষয়ে মাস্টার্স করার জন্য পূর্ণ স্কলারশিপ পেয়েছেন। একই সঙ্গে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগও দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু স্কলারশিপের সেই সুযোগ নিতে গাজা ছেড়ে বাংলাদেশ আসতে পারছেন না মাহা। ফিলিস্তিনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। তাই বাংলাদেশের ভিসা সংগ্রহ করতে হলে তাকে পার্শ্ববর্তী দেশ জর্ডানের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে স্ব-শরীরে আবেদন করতে হবে।

বর্তমানে আমরা প্রায় ৮০ জন ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়ালেখা করছি। তবে বর্ডার ইস্যুর কারণে গত বছর ২২০ জন ফিলিস্তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়েও আসতে পারেনি।–শিক্ষার্থী বাদউই আহমেদ

গাজায় কোনো বিমানবন্দর নেই, আর চারপাশের সব সীমান্ত ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে থাকায় সরাসরি জর্ডানে যাওয়া মাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখনো ই-ভিসাও চালু করা হয়নি।

ফলে একদিকে নিজ দেশে চলমান যুদ্ধ, প্রাণহানি ও অনিশ্চয়তার ভয়, অন্যদিকে বহু কষ্টে অর্জিত স্কলারশিপ হারানোর আশঙ্কা—এই দুই বিপরীত বাস্তবতার মধ্যেই দিন কাটছে মাহার।

মাহার মতো অনেক শিক্ষার্থীই প্রতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফুল স্কলারশিপে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ফুল স্কলারশিপ ও চাকরির অফার পেয়েও শুধু দূতাবাসের সহযোগিতা না পাওয়ায় সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারছি না। অন্য অনেক দেশের দূতাবাস তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের সমন্বয় করে আসছে।–শিক্ষার্থী মাহা আদনান শাবাইর

বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষার্থে আসা ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের সংগঠন জেনারেল ইউনিয়ন অব প্যালেস্টাইন স্টুডেন্ট ইন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্র বাদউই আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা প্রায় ৮০ জন ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়ালেখা করছি। তবে বর্ডার ইস্যুর কারণে গত বছর ২২০ জন ফিলিস্তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়েও আসতে পারেনি।’

তবে এবছর ফিলিস্তিনের কতজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ স্কলারশিপ পেয়েছেন সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নন বলেন জানান বাদউই আহমেদ।

বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ফলে তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের সুযোগ নেই। ভিসা অন-অ্যারাইভালের সুযোগ আছে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা পান। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেটা দেয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই অ্যাপ্রুভাল নিতে পারে।- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম

জানা যায়, গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের (কেবল ছাত্র, পরিবার এবং রোগীদের) বের হওয়ার একমাত্র পথ এখন ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা কারেম আবু সালেম ক্রসিং। তবে এর জন্য তাদের কাছে সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা থাকতে হবে এবং ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বের হওয়ার অনুমতি পেতে হবে।

ফলে এখন জরুরি প্রয়োজন ও বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া কোনো ফিলিস্তিনির পক্ষে দেশ ছাড়ার সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে গাজা থেকে বের হওয়ার জন্য গন্তব্য দেশের দূতাবাসগুলোকেই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। তবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না।

দক্ষিণ গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে জাগো নিউজকে মাহা জানান, ফিলিস্তিনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস না থাকায় সাধারণত জর্ডান ও মিশরে অবস্থিত দূতাবাসগুলো এসব কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করে।

বাংলাদেশ কখনো ফিলিস্তিনিদের ভিসা দিতে সমস্যা করেনি। প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদার সেনাবাহিনী, যারা রাফা সীমান্ত দিয়ে ফিলিস্তিনিদের মিশরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। বর্তমানে রাফা সীমান্ত পুরোপুরি ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।- বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান

‘গাজার একমাত্র চলাচলের পথ কেরেম আবু সালেম সীমান্ত, যা জর্ডানের দিকে। তাই আমি জর্ডানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে সহযোগিতার জন্য ইমেইল করি। আমি তাদের জানাই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র পাওয়া ছাড়া গাজা ছাড়ার কোনো উপায় নেই, আর সে অনুমতির জন্য দূতাবাসের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলেই দূতাবাসে সরাসরি উপস্থিত হয়ে ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবো।’ বলেন মাহা।

তবে দূতাবাস এ ধরনের সহায়তা করতে অপরাগ বলে জানিয়েছে। আর এটাই মাহাদের মতো বাংলাদেশে স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্রদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘এ ধরনের সমন্বয় ছাড়া আমি বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌঁছাতে পারছি না, কার্যত আমরা বন্দি অবস্থায় আছি।’ বলেন মাহা।

স্কলারশিপ পেলেও বাংলাদেশে আসতে পারছেন না ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা

‘বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ফুল স্কলারশিপ ও চাকরির অফার পেয়েও শুধু দূতাবাসের সহযোগিতা না পাওয়ায় সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘অন্য অনেক দেশের দূতাবাস তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের সমন্বয় করে আসছে। আমার এক বন্ধু সম্প্রতি ফ্রান্স থেকে মাস্টার্স স্কলারশিপ পেয়েছে। ফ্রান্সের দূতাবাস তার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি আদায় করে গাজা ছাড়তে সহায়তা করেছে।’

মাহার আকুতি, ‘আমি চাই, বাংলাদেশ দূতাবাসও আমাদের পাশে দাঁড়াক, যেমনটা অন্য দেশের দূতাবাসগুলো করছে।’

কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই ইসরায়েলের সঙ্গে

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ফলে তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের সুযোগ নেই। ভিসা অন-অ্যারাইভালের সুযোগ আছে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা পান। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেটা দেয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই অ্যাপ্রুভাল নিতে পারে।’

তবে ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশের দূতাবাস ফিলিস্তিনের শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের গাজা থেকে নিরাপদে বের করে নিয়ে গেছে। দূতাবাসগুলো বিকল্প হিসেবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর, এমএসএফ কিংবা মিশর ও জর্ডানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতির সঙ্গেও সামঞ্জস্য রেখে ফিলিস্তিনের নাগরিকদের জন্য দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

এদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ কখনো ফিলিস্তিনিদের ভিসা দিতে সমস্যা করেনি। প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদার সেনাবাহিনী, যারা রাফা সীমান্ত দিয়ে ফিলিস্তিনিদের মিশরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। বর্তমানে রাফা সীমান্ত পুরোপুরি ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।’

‘আমরা কাউকে ইসরায়েলি গেট দিয়ে গাজা ছাড়ার পরামর্শ দিই না। কারণ, যারা সে পথ দিয়ে গাজা ছাড়ে, তাদের আর ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয় না। এটি ইসরায়েলের একটি পরিকল্পিত কৌশল—ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে চিরতরে সরিয়ে দিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের বসানো। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তার চরমপন্থি সরকার প্রকাশ্যেই এ নীতিকে সমর্থন করেছে।’

স্কলারশিপ পেলেও বাংলাদেশে আসতে পারছেন না ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা

রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সব সময় ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবির পক্ষে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক রীতিনীতি শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসরণ করে আসছে।’

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা তিনটি প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভক্ত। উত্তর গাজা অঞ্চলে রয়েছে বেইত হানউন, বেইত লাহিয়া ও জাবালিয়া শহর। এ অঞ্চলটি ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত এরেজ ক্রসিংয়ের কাছাকাছি অবস্থিত।

মধ্য গাজা এলাকায় রয়েছে নুসেইরাত, দেইর আল-বালাহ, মাঘাজি ও বুরেইজ। এখানে বহু শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছে, যেখানে যুদ্ধ ও মানবিক সংকটের চিহ্ন আরও প্রকট।

দক্ষিণ গাজা অঞ্চলে রয়েছে খান ইউনুস ও রাফাহ, যা গাজার অন্যতম বৃহৎ শহর। এ অংশটি কেরেম আবু সালেম ক্রসিংয়ের সন্নিকটে অবস্থিত।

ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা জানান, কেরেম আবু সালেম ক্রসিং দিয়ে গাজা ছাড়ার পর জর্ডানে পৌঁছাতে হলে ইসরায়েল হয়ে ট্রানজিট নিতে হয়। এই যাত্রাপথ সাধারণত পশ্চিম তীর (ওয়েস্ট ব্যাংক) অতিক্রম করে এবং শেষ হয় জর্ডান সীমান্তে অবস্থিত আলেনবি ব্রিজে (কিং হুসেইন ক্রসিং নামেও পরিচিত)।

দিন কাটছে মৃত্যু আর ধ্বংসের মাঝে

গাজার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ, আর দিনে দিনে তা আরও খারাপ হচ্ছে—বলছিলেন মাহা।

তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতিদিনই মৃত্যু, ধ্বংস, বোমা হামলা আর গোলাবর্ষণ চলছে। কোনো দিন শান্তিপূর্ণভাবে কাটছে না।’

এখন মাহা একসঙ্গে আছেন তার বাবা-মা, ছোট ভাই, বোন, বোনের স্বামী ও তাদের ছোট সন্তান, খালা ও খালাতো দুই বোনকে নিয়ে।

মাহা জানান, সবশেষ মে মাসে তারা নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

‘এই নিয়ে ছয়বার পালাতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু এবার আর ফেরার উপায় নেই, কারণ আমাদের বাড়ি একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে একটি ইসরায়েলি বিমান হামলায়।’ বলেন মাহা।

‘আমরা কখনো তাদের ক্ষমা করবো না—যারা নিজেদের মুসলিম বলে, অথচ গাজায় আমাদের ওপর চলা নিপীড়নের সময় চুপ থাকে। এই ভয়, ক্ষুধা আর হারানোর যন্ত্রণা তাদের নীরবতারও দায়,’ বলেন মাহা।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আইহাও আলইয়ামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে এখানে মেডিকেল কলেজে পড়তে পারছি। এজন্য আমরা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানি না। আমার পরিবার ফিলিস্তিনে আছে, তবে এমন পরিস্থিতে যেখানে এক সপ্তাহের পরিকল্পনাও তারা করতে পারে না।’

জেপিআই/এএসএ/এমএফএজিকেএস