০৭:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

একাত্তরের অবরুদ্ধ ঢাকা: আমিও বিজয় দেখেছি

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ০৬:০৮:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
  • 6

আমাদের মুক্তি সংগ্রাম যখন শুরু হলো, তখন আমার বয়স ৬ বছর। এতবড় একটি যুদ্ধ আমি পরিবারের সাথে অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকে দেখেছি। অনুভব করেছি একটা যুদ্ধ কীভাবে মানুষের দিনলিপিকে পাল্টে দিতে পারে। বয়স্ক মানুষ থেকে শুরু করে আমার মতো শিশুর জীবনও। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমার মতো কত শিশু বাস্তুচ্যুত হয়েছে, কতজন পরিবার হারিয়েছে, হারিয়ে ফেলেছে ঠিকানা। আমি সেই শিশুদের একজন যে অবরুদ্ধ ঢাকায় বা ভ’তুড়ে পাড়ায় মা-বাবার সাথেই ছিলাম – ভয়াবহ গোলাগুলি, চারদিকে থমথমে পরিবেশ, ভয়, পাড়ায় পাড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তল্লাশি উপেক্ষা করে।

কারণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, নৌকায় বা হেঁটে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার উপায় ছিল না আমার এ্যাজমা রোগী আব্বার। দেশের অবস্থা কতটা ভয়াবহ ও বিপজ্জনক, তখন তা পুরোটা না বুঝলেও, পরে বুঝেছি আমাদের সবার জীবনের ওপর অনেক গভীর প্রভাব ফেলেছে এই সংগ্রাম। তাই হয়তো ঐ সময়ের এমন অনেক স্মৃতিই মনে তরতাজা রয়েছে। এখন মনেহয় সেসময় অনেককিছুই আমি বুঝতাম। কী জানি মানুষের জীবনে বড় ঘটনাগুলোর স্মৃতিই বোধহয় এরকম, যে-কোনো বয়সের মানুষই যা মনে রাখতে পারে।

আমাদের মানে বাচ্চাদের সারাদিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর খেলা ছাড়া কোনো কাজ নেই। স্কুল তেমনভাবে চলছিল না। কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি টুংটাং বেল বাজানো বেবি আইসক্রীমওয়ালা আর আসছে না। প্রতি সপ্তাহে পাড়ায় একটা ভাল্লুকভালা আসতো খেলা দেখাতে, একটা বাঁদরনাচওয়ালাও আসতো, একটা সাপুড়েও বাঁশি বাজিয়ে খেলা দেখাতো, সাপের খেলা। কিন্তু পরিস্থিতি কেমন যেন থমথমে হয়ে যাওয়াতে সবাই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। বাতাসে আনন্দ মুছে গিয়ে শুধু ঠান্ডা, গুমোট একটা অনুভ’তি। ছোট হলেও বুঝতে পারছিলাম কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে।

২৫ মার্চের কালরাত ছিল ভয়াবহ একটি রাত। যা ভোলা অসম্ভব। সম্ভবত রাতের খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ চারিদিক থেকে গুলি, মেশিন গান এবং আরো অনেক শব্দ ভেসে আসতে থাকলো। কাঁচের জানালা দিয়ে আগুনের আলোও দেখা যাচ্ছিল। আব্বা, আম্মা, আমি লাইট নিভিয়ে খাটের নীচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের কাছে ছিল কিছু শুকনো বিস্কুট আর একটা ছোট্ট হারিকেন। পরে শুনেছি পাকিস্তানিরা যেন নির্বিঘ্নে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারে সেজন্য, ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্ল্যাক আউট চলছিল।

স্পষ্ট মনে আছে আমি আমার ছোট দুইটা পুতুল নিয়ে খাটের নীচে ঢুকেছিলাম। মনে ভেবেছিলাম যদি দুষ্টু লোকেরা আসে, তাহলেতো আমার পুতুল দুটিকে নিয়ে যাবে। সেদিন ভাবিনি ঐ হায়েনারা আমার দেশকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য সেই রাতেই বর্বর হামলা চালিয়েছিল। শুধু আমার পুতুল কেন, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ওরা নির্বিচারে। অগণিত নারী শিশুকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।

গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে ভয় পেয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,“আব্বা কী হচ্ছে চারিদিকে? এত গুলির শব্দ, এত আগুনের আলো কেন দেখা যাচ্ছে? ওরা কি আমাদের মেরে ফেলবে?” কী ভয়ংকর ট্রমা হয়েছিল তখন, তা আমি এখনো কল্পনা করতে পারিনা। আমাদের দৈনন্দিন সাদামাটা কিন্তু আনন্দময় জীবনে বড় একটা ঝড় এসেছিল। আব্বা বলেছিল, “মা পশ্চিম পাকিস্তান নামে একটা শয়তান দেশ আছে, ওরা আমাদের দেশকে কেড়ে নিতে চায়। আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে, যার যা কিছু আছে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আব্বা বলেছিল কাঁদিস না মা। তুই তোর পুতুল সামলা, দেশের মানুষ দেশটাকে সামলাবে।”

আম্মা আমাকে বুকে চেপে ধরে শুধু দোয়া পড়ে যাচ্ছিল। এত গোলাগুলির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল হয়তো আমাদের পাড়াতেই কেউ বোমা ফেলছে। এত কমলা রঙা আগুনের ঝলকানি দেখে মনে হয়েছিল এক্ষুনি হয়তো একটা আগুনের গোলা এসে পড়বে আমাদের অন্ধকার ঘরে। নিশ্চুপ একটা রাতে শুধু বোমা আর গুলির শব্দ শুনে আমি ভয়ে কাঁদতে থাকলাম।

আম্মাকে দেখেছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। আম্মা কাঁদছে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝেছি আম্মার ঐ কান্নাটি ছিল আনন্দের। এতো মানুষকে পাড়ার মোড়ে জড়ো হতে দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি, আরে এত মানুষ কোথা থেকে এল পাড়ায়? আমিতো এতদিন দেখেছি আমাদের পাড়া শুধু খালি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ দলবেঁধে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। তখন আমার বয়সটাই ছিল অনেক প্রশ্নের, কিন্তু উত্তর মিলতো কম।

আব্বা আমার মুখ চেপে ধরে আস্তে আস্তে কাঁদতে বলল। আব্বা ফিসফিস করে বলল, ”গুলির আওয়াজ আসছে রাজারবাগের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে”। আমার মনে হয়েছিল ওরা মনে হয় মানুষ না, আমার ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে পড়া সেই দানোর দল, যাদের মুখ থেকে আগুন বের হয়। বড় হয়ে বুঝেছি, ওরা আসলে সেই দানবই ছিল ।

১৯৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অসংখ্য টুকরো স্মৃতি রয়েছে আমার। সম্ভবত অক্টোবর – নভেম্বর মাস, বেশ ঠান্ডা এবং চারিদিকে কুয়াশায় ঢাকা। আমাদের ভূতের গলির পাড়াটা জনশূন্য হয়ে যাওয়ায় আমরা বাসা বদলে গ্রিনরোড এলাকার নর্থ সার্কুলার রোডে চলে এসেছি।

আমার ফুপাতো ভাই, মুন তখন একজন তরুণ। সন্ধ্যায় রংপুর থেকে ঢাকা এসেছে একটা কাজে। শুনলাম দু’একদিন থেকেই চলে যাবে। সেই রাতেই মুন ভাই তার ব্যাগটা খুলে আব্বাকে ভেতরে কী যেন দেখালো। দুজনে ফিসফিস করে কথাও বলছিল। এদিকে ব্যাগে কী আছে, তা দেখার জন্য আমার উৎসাহও বেড়ে গলা পর্যন্ত হয়ে গেল। ঘরে ঘুরতে ঘুরতে এক ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখলাম, ব্যাগটার ভেতর অস্ত্র। আমাদের বাসায় বন্দুক (তখন আমি শুধু বন্দুককেই আগ্নেয়াস্ত্র বলে মনে করতাম) দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আব্বা টের পেয়ে বারবার করে আমাকে নিষেধ করে দিল যে এই কথাটা যেন আমি কাউকে না বলি। 

পরদিন সকাল গড়াতেই পাড়ার ২/১ জন আব্বাকে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,  “হুদা ভাই আপনার বাসায় নাকি অস্ত্র আছে? আপনার বোনের ছেলে নাকি ওগুলো নিয়ে এসেছে?” আব্বা মুহূর্তেই টের পেল, খবর রটানোর এই কাজটি কার? সেদিন সন্ধ্যায়ই মুন ভাই গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে, তার ব্যাগটি নিয়ে হঠাৎই গায়েব হয়ে গেল। আমি টেরই পেলাম না।

পরে বুঝতে পেরেছিলাম খবর রটানোর উত্তেজনার বশে ভয়াবহ একটি তথ্য আমি একান-ওকান করেছি। মুন ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রের চালান নিয়ে এসেছিল। এরকম অনেক ঘটনার কথা আমার স্পষ্ট অথবা টুকরা টুকরা মনে আছে।

যেদিন আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিকালে আম্মার হাত ধরে পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে গ্রিনরোডের মাথায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম মুক্তিযোদ্ধারা জিপে ও ট্রাকে করে হাত নেড়ে, বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে উড়াতে যাচ্ছেন। তাদের দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন অগণিত মানুষ বড়রা অনেকেই কাঁদছেন, কেউবা হাসছেন, বাচ্চারা লাফালাফি করছে, যোদ্ধাদের সাথে হাত মেলাচ্ছে। অনেকের হাতেই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমাদের বাসায় লুকিয়ে রাখা ছোট পতাকাটি কোনো একটি বাক্স থেকে বের করে আম্মা আমার হাতে দিয়েছিল। 

আম্মাকে দেখেছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। আম্মা কাঁদছে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝেছি আম্মার ঐ কান্নাটি ছিল আনন্দের। এতো মানুষকে পাড়ার মোড়ে জড়ো হতে দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি, আরে এত মানুষ কোথা থেকে এল পাড়ায়? আমিতো এতদিন দেখেছি আমাদের পাড়া শুধু খালি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ দলবেঁধে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। তখন আমার বয়সটাই ছিল অনেক প্রশ্নের, কিন্তু উত্তর মিলতো কম।

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ – আব্বা, আম্মা এবং পাড়ার আরো অনেকের সাথে দলবেঁধে বের হলাম তেজগাঁওতে এয়ারপোর্ট দেখবো বলে। সবাই বলাবলি করছিল আমাদের বিমানবন্দরটি পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংস করে দিয়েছে।

সারাটা পথে কাঁচের টুকরা, ছড়ানো ছিটানো গোলাবারুদ, ভাঙা গাড়ি, পোড়া ও ভাঙা বাড়িঘর দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম তেজগাঁও, আমাদের বিমানবন্দরের ধ্বংসস্তূপ দেখতে। একটি বিধ্বস্ত জনপদ দিয়ে আমরা পথ হেঁটেছি। এখন ভাবতে পারিনা এই আমি, অতটুকু একটি মেয়ে কেমন করে পায়ে হেঁটে ফার্মগেট হয়ে বিমানবন্দর দেখতে গেলাম গ্রিনরোড থেকে? বিজয়ের আনন্দেই হয়তো সব সহজ হয়ে গিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম অনেককিছু। সেসবের কিছুই এখন আর আমার কাছে নাই, শুধু রেখে দিয়েছি বিমান বিধ্বংসী গোলার একটি খালি খোল আর মুক্তিযুদ্ধের কিছু তরতাজা স্মৃতি।

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

ট্যাগঃ
জনপ্রিয় খবর

একাত্তরের অবরুদ্ধ ঢাকা: আমিও বিজয় দেখেছি

আপডেট সময়ঃ ০৬:০৮:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

আমাদের মুক্তি সংগ্রাম যখন শুরু হলো, তখন আমার বয়স ৬ বছর। এতবড় একটি যুদ্ধ আমি পরিবারের সাথে অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকে দেখেছি। অনুভব করেছি একটা যুদ্ধ কীভাবে মানুষের দিনলিপিকে পাল্টে দিতে পারে। বয়স্ক মানুষ থেকে শুরু করে আমার মতো শিশুর জীবনও। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমার মতো কত শিশু বাস্তুচ্যুত হয়েছে, কতজন পরিবার হারিয়েছে, হারিয়ে ফেলেছে ঠিকানা। আমি সেই শিশুদের একজন যে অবরুদ্ধ ঢাকায় বা ভ’তুড়ে পাড়ায় মা-বাবার সাথেই ছিলাম – ভয়াবহ গোলাগুলি, চারদিকে থমথমে পরিবেশ, ভয়, পাড়ায় পাড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তল্লাশি উপেক্ষা করে।

কারণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, নৌকায় বা হেঁটে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার উপায় ছিল না আমার এ্যাজমা রোগী আব্বার। দেশের অবস্থা কতটা ভয়াবহ ও বিপজ্জনক, তখন তা পুরোটা না বুঝলেও, পরে বুঝেছি আমাদের সবার জীবনের ওপর অনেক গভীর প্রভাব ফেলেছে এই সংগ্রাম। তাই হয়তো ঐ সময়ের এমন অনেক স্মৃতিই মনে তরতাজা রয়েছে। এখন মনেহয় সেসময় অনেককিছুই আমি বুঝতাম। কী জানি মানুষের জীবনে বড় ঘটনাগুলোর স্মৃতিই বোধহয় এরকম, যে-কোনো বয়সের মানুষই যা মনে রাখতে পারে।

আমাদের মানে বাচ্চাদের সারাদিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর খেলা ছাড়া কোনো কাজ নেই। স্কুল তেমনভাবে চলছিল না। কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি টুংটাং বেল বাজানো বেবি আইসক্রীমওয়ালা আর আসছে না। প্রতি সপ্তাহে পাড়ায় একটা ভাল্লুকভালা আসতো খেলা দেখাতে, একটা বাঁদরনাচওয়ালাও আসতো, একটা সাপুড়েও বাঁশি বাজিয়ে খেলা দেখাতো, সাপের খেলা। কিন্তু পরিস্থিতি কেমন যেন থমথমে হয়ে যাওয়াতে সবাই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। বাতাসে আনন্দ মুছে গিয়ে শুধু ঠান্ডা, গুমোট একটা অনুভ’তি। ছোট হলেও বুঝতে পারছিলাম কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে।

২৫ মার্চের কালরাত ছিল ভয়াবহ একটি রাত। যা ভোলা অসম্ভব। সম্ভবত রাতের খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ চারিদিক থেকে গুলি, মেশিন গান এবং আরো অনেক শব্দ ভেসে আসতে থাকলো। কাঁচের জানালা দিয়ে আগুনের আলোও দেখা যাচ্ছিল। আব্বা, আম্মা, আমি লাইট নিভিয়ে খাটের নীচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের কাছে ছিল কিছু শুকনো বিস্কুট আর একটা ছোট্ট হারিকেন। পরে শুনেছি পাকিস্তানিরা যেন নির্বিঘ্নে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারে সেজন্য, ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্ল্যাক আউট চলছিল।

স্পষ্ট মনে আছে আমি আমার ছোট দুইটা পুতুল নিয়ে খাটের নীচে ঢুকেছিলাম। মনে ভেবেছিলাম যদি দুষ্টু লোকেরা আসে, তাহলেতো আমার পুতুল দুটিকে নিয়ে যাবে। সেদিন ভাবিনি ঐ হায়েনারা আমার দেশকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য সেই রাতেই বর্বর হামলা চালিয়েছিল। শুধু আমার পুতুল কেন, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ওরা নির্বিচারে। অগণিত নারী শিশুকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।

গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে ভয় পেয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,“আব্বা কী হচ্ছে চারিদিকে? এত গুলির শব্দ, এত আগুনের আলো কেন দেখা যাচ্ছে? ওরা কি আমাদের মেরে ফেলবে?” কী ভয়ংকর ট্রমা হয়েছিল তখন, তা আমি এখনো কল্পনা করতে পারিনা। আমাদের দৈনন্দিন সাদামাটা কিন্তু আনন্দময় জীবনে বড় একটা ঝড় এসেছিল। আব্বা বলেছিল, “মা পশ্চিম পাকিস্তান নামে একটা শয়তান দেশ আছে, ওরা আমাদের দেশকে কেড়ে নিতে চায়। আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে, যার যা কিছু আছে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আব্বা বলেছিল কাঁদিস না মা। তুই তোর পুতুল সামলা, দেশের মানুষ দেশটাকে সামলাবে।”

আম্মা আমাকে বুকে চেপে ধরে শুধু দোয়া পড়ে যাচ্ছিল। এত গোলাগুলির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল হয়তো আমাদের পাড়াতেই কেউ বোমা ফেলছে। এত কমলা রঙা আগুনের ঝলকানি দেখে মনে হয়েছিল এক্ষুনি হয়তো একটা আগুনের গোলা এসে পড়বে আমাদের অন্ধকার ঘরে। নিশ্চুপ একটা রাতে শুধু বোমা আর গুলির শব্দ শুনে আমি ভয়ে কাঁদতে থাকলাম।

আম্মাকে দেখেছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। আম্মা কাঁদছে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝেছি আম্মার ঐ কান্নাটি ছিল আনন্দের। এতো মানুষকে পাড়ার মোড়ে জড়ো হতে দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি, আরে এত মানুষ কোথা থেকে এল পাড়ায়? আমিতো এতদিন দেখেছি আমাদের পাড়া শুধু খালি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ দলবেঁধে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। তখন আমার বয়সটাই ছিল অনেক প্রশ্নের, কিন্তু উত্তর মিলতো কম।

আব্বা আমার মুখ চেপে ধরে আস্তে আস্তে কাঁদতে বলল। আব্বা ফিসফিস করে বলল, ”গুলির আওয়াজ আসছে রাজারবাগের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে”। আমার মনে হয়েছিল ওরা মনে হয় মানুষ না, আমার ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে পড়া সেই দানোর দল, যাদের মুখ থেকে আগুন বের হয়। বড় হয়ে বুঝেছি, ওরা আসলে সেই দানবই ছিল ।

১৯৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অসংখ্য টুকরো স্মৃতি রয়েছে আমার। সম্ভবত অক্টোবর – নভেম্বর মাস, বেশ ঠান্ডা এবং চারিদিকে কুয়াশায় ঢাকা। আমাদের ভূতের গলির পাড়াটা জনশূন্য হয়ে যাওয়ায় আমরা বাসা বদলে গ্রিনরোড এলাকার নর্থ সার্কুলার রোডে চলে এসেছি।

আমার ফুপাতো ভাই, মুন তখন একজন তরুণ। সন্ধ্যায় রংপুর থেকে ঢাকা এসেছে একটা কাজে। শুনলাম দু’একদিন থেকেই চলে যাবে। সেই রাতেই মুন ভাই তার ব্যাগটা খুলে আব্বাকে ভেতরে কী যেন দেখালো। দুজনে ফিসফিস করে কথাও বলছিল। এদিকে ব্যাগে কী আছে, তা দেখার জন্য আমার উৎসাহও বেড়ে গলা পর্যন্ত হয়ে গেল। ঘরে ঘুরতে ঘুরতে এক ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখলাম, ব্যাগটার ভেতর অস্ত্র। আমাদের বাসায় বন্দুক (তখন আমি শুধু বন্দুককেই আগ্নেয়াস্ত্র বলে মনে করতাম) দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আব্বা টের পেয়ে বারবার করে আমাকে নিষেধ করে দিল যে এই কথাটা যেন আমি কাউকে না বলি। 

পরদিন সকাল গড়াতেই পাড়ার ২/১ জন আব্বাকে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,  “হুদা ভাই আপনার বাসায় নাকি অস্ত্র আছে? আপনার বোনের ছেলে নাকি ওগুলো নিয়ে এসেছে?” আব্বা মুহূর্তেই টের পেল, খবর রটানোর এই কাজটি কার? সেদিন সন্ধ্যায়ই মুন ভাই গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে, তার ব্যাগটি নিয়ে হঠাৎই গায়েব হয়ে গেল। আমি টেরই পেলাম না।

পরে বুঝতে পেরেছিলাম খবর রটানোর উত্তেজনার বশে ভয়াবহ একটি তথ্য আমি একান-ওকান করেছি। মুন ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রের চালান নিয়ে এসেছিল। এরকম অনেক ঘটনার কথা আমার স্পষ্ট অথবা টুকরা টুকরা মনে আছে।

যেদিন আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিকালে আম্মার হাত ধরে পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে গ্রিনরোডের মাথায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম মুক্তিযোদ্ধারা জিপে ও ট্রাকে করে হাত নেড়ে, বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে উড়াতে যাচ্ছেন। তাদের দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন অগণিত মানুষ বড়রা অনেকেই কাঁদছেন, কেউবা হাসছেন, বাচ্চারা লাফালাফি করছে, যোদ্ধাদের সাথে হাত মেলাচ্ছে। অনেকের হাতেই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমাদের বাসায় লুকিয়ে রাখা ছোট পতাকাটি কোনো একটি বাক্স থেকে বের করে আম্মা আমার হাতে দিয়েছিল। 

আম্মাকে দেখেছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। আম্মা কাঁদছে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝেছি আম্মার ঐ কান্নাটি ছিল আনন্দের। এতো মানুষকে পাড়ার মোড়ে জড়ো হতে দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি, আরে এত মানুষ কোথা থেকে এল পাড়ায়? আমিতো এতদিন দেখেছি আমাদের পাড়া শুধু খালি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ দলবেঁধে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। তখন আমার বয়সটাই ছিল অনেক প্রশ্নের, কিন্তু উত্তর মিলতো কম।

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ – আব্বা, আম্মা এবং পাড়ার আরো অনেকের সাথে দলবেঁধে বের হলাম তেজগাঁওতে এয়ারপোর্ট দেখবো বলে। সবাই বলাবলি করছিল আমাদের বিমানবন্দরটি পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংস করে দিয়েছে।

সারাটা পথে কাঁচের টুকরা, ছড়ানো ছিটানো গোলাবারুদ, ভাঙা গাড়ি, পোড়া ও ভাঙা বাড়িঘর দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম তেজগাঁও, আমাদের বিমানবন্দরের ধ্বংসস্তূপ দেখতে। একটি বিধ্বস্ত জনপদ দিয়ে আমরা পথ হেঁটেছি। এখন ভাবতে পারিনা এই আমি, অতটুকু একটি মেয়ে কেমন করে পায়ে হেঁটে ফার্মগেট হয়ে বিমানবন্দর দেখতে গেলাম গ্রিনরোড থেকে? বিজয়ের আনন্দেই হয়তো সব সহজ হয়ে গিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম অনেককিছু। সেসবের কিছুই এখন আর আমার কাছে নাই, শুধু রেখে দিয়েছি বিমান বিধ্বংসী গোলার একটি খালি খোল আর মুক্তিযুদ্ধের কিছু তরতাজা স্মৃতি।

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।