জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া পাঠিয়েছে। তবে এতে সংস্কার কার্য সম্পাদনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা রাখা হয়নি, যা কমিশনের আগের অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
২৮ জুলাই প্রকাশিত প্রাথমিক খসড়ায় কমিশন বলেছিল, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সব সংস্কার কার্য সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলগুলোকে দিতে হবে।
কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় কমিশন বলছে, যেসব সুপারিশ ‘অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য’ বলে বিবেচিত হবে, তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে দ্রুত, কার্যকর ও যথোপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে নির্বাচনের আগেই। তবে কোন সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, তা খসড়ায় উল্লেখ করা হয়নি।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ নিশ্চিত করেছেন যে চূড়ান্ত সমন্বিত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, ভাষা ও শব্দচয়ন বিষয়ে মতামত জানাতে দলগুলোকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। ‘বিষয়বস্তু অপরিবর্তিত থাকবে,’ বলেন তিনি।
চার্টারে কোনো সময়সীমা না রাখার বিষয়ে প্রশ্ন করলে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘প্রাথমিক খসড়ায় দুই বছরের সময়সীমা কেবল আলোচনা শুরু করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছিল। এটা কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল না।’
অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো আলাদা করে না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারই চিহ্নিত করবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
কমিশনের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সময়সীমা মূলত আলোচনার সূচনা করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছিল। এখন আমরা সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিয়ে আলোচনা করছি। একবার সেটি নির্ধারিত হলে সময়সীমাও স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসবে।’
চূড়ান্ত খসড়ায় ২০ মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দুই দফা আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ৮৪ দফায় ঐকমত্য হয়, তা সংযোজন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিএনপি ও আরও কয়েকটি দলের ভিন্নমতও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভিন্নমতগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে মানতে হবে কি না—এমন প্রশ্নে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে তারা যা বলবেন, দলগুলো সেটি মানতে বাধ্য থাকবে।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটকে অগ্রাধিকার দিয়ে কমিশন আট দফা অঙ্গীকারের প্রতিশ্রুতি চাইছে।
সনদে বলা হয়েছে, এর সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে দেওয়া ত্যাগ ও জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে। একে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কাঠামো হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে।
চার্টারে রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানানো হয়েছে এর সব প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। বিদ্যমান আইন বা সংবিধানের সঙ্গে এর কোনো দ্বন্দ্ব দেখা দিলে, সনদকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এর যে কোনো ধারা বা সুপারিশ ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আপিল বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, সনদের প্রতিটি প্রস্তাবই সংবিধানগত ও আইনি দিক থেকে বাধ্যতামূলক হবে এবং এর বৈধতা বা প্রয়োজনীয়তা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
চার্টারে জনগণের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—বিশেষত ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার অঙ্গীকার রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানানো হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে, শহীদদের রাষ্ট্রীয় সম্মান দিতে, তাদের পরিবারকে সহায়তা করতে এবং আহতদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিতে।
প্রাথমিক খসড়ায় বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা ‘২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে যথোপযুক্তভাবে সংবিধানে সংরক্ষণ করবে।’ তবে সেখানে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বৃহত্তর স্বীকৃতি বা নিহতদের ন্যায়বিচারের বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না।
চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, যদিও ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কোনো সংবিধান কার্যকর ছিল না, তবুও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই সময়ে সম্পাদিত সব কার্যক্রমকে ১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং সেগুলোকে আইনগত ও সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।
এতে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ, তার উপ-রাষ্ট্রপতি হওয়া, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ ও পুনরায় বিচার বিভাগে প্রত্যাবর্তনের কোনো সাংবিধানিক কাঠামো ছিল না। ‘তবুও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে এসব পদক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল এবং পরবর্তী সংসদ জনগণের ইচ্ছা হিসেবে তা অনুমোদন করে, যা সাংবিধানিক প্রচলন ও গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করেছিল।’
কেএইচ/এমআরএম