চব্বিশের ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট। এসময়ে ইবনে সিনা হাসপাতালে আসতে থাকেন গুলিবিদ্ধ অসংখ্য ছাত্রজনতা। কিন্তু তাদের সেবায় বাধা হয়ে দাঁড়ান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নজরদারি বাড়ান পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। আর এসব ভয়ে জুলাই-আগস্টে আহতদের লুকিয়ে রেখে ভিন্ন রোগীর কথা বলে চিকিৎসা দেন চিকিৎসকরা। এমনকি গুলিবিদ্ধদের ভিন্ন নাম-ঠিকানায় কিংবা ভিন্ন রোগে হাসপাতালে রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ডাক্তারের সাক্ষীর জবানবন্দিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষী হিসেবে বুধবার (২০ আগস্ট) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেলে জবানবন্দি দেন ডা. হাসানুল বান্না। তিনি রাজধানীর কল্যাণপুর ইবনে সিনা হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি ও জেরার কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।
সাক্ষীর ডায়াসে উঠেই শুরুতে নিজের পরিচয় দেন ডা. বান্না। জবানবন্দিতে ৪৩ বছর বয়সী এ চিকিৎসক বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই এবং ২, ৩, ৪ ও ৫ আগস্টসহ পরবর্তী সময়ে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অসংখ্য ছাত্রজনতাকে চিকিৎসা দিই। ১৮ জুলাই দুপুরের পর থেকেই আমাদের হাসপাতালে আহতরা আসতে থাকেন। যাদের অনেকের অপারেশন করতে হয়েছে। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যার পর হাসপাতালে এসে চিকিৎসায় বাধা দেন পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আহতদের ভর্তি করতেও নিষেধ করেন তারা।
একই সঙ্গে রেজিস্টার দেখে রোগীদের তালিকা নিয়ে যান। এখানেই থেমে থাকেননি পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ১৯ জুলাই সকাল থেকে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ কর্মীরা হাসপাতালের গেট অবরোধ করে চেয়ার নিয়ে সারাদিন বসে ছিলেন। তারা কোনো রোগীকে হাসপাতালে ঢুকতে দেননি। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে-বের হতেও দেওয়া হয়নি। ওই দিন মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে গুলিবিদ্ধ হন ইবনে সিনা হাসপাতালের টেকনোলোজিস্ট মিতুর স্বামী মোস্তাকিন বিল্লাহ। যিনি ইনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টেকনোলোজিস্ট ছিলেন।
ডা. বান্না বলেন, গুলিবিদ্ধ মোস্তাকিনকে বিকল্প পথে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার জরুরি অপারেশনের প্রয়োজনে নিউরো সার্জন আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অ্যাম্বুলেন্স বের হতে দেননি। এরপর তাকে বিকল্প পথে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে সেখানে তাকে ভর্তি নেয়া হয়নি। পরে ইবনে সিনা ধানমন্ডি শাখায় নিলে চিকিৎসকরা মোস্তাকিনকে মৃত ঘোষণা করেন।
জবানবন্দিতে এ সাক্ষী বলেন, ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে আসা গুলিবিদ্ধদের ভিন্ন নামে ও ভিন্ন রোগের কথা উল্লেখ করে লুকিয়ে রেখে গোপনে চিকিৎসা দিই আমরা। মূলত পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে তাদের সাধারণ ওয়ার্ডে না রেখে পোস্ট অপারেটিভ, আইসিইউ ও বিশেষ কেবিনে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দেন ইবনে সিনা হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
এসব ঘটনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনকে দায়ী করেন ডা. হাসানুল বান্না। তিনি বলেন, এসব ঘটনার জন্য শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকসহ আওয়ামী লীগের নেতা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়ী মনে করি। আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে এ ঘটনার সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি।
এদিন হাসানুল বান্না ছাড়াও আরও তিনজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হলেন- ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, একই হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভীন ও শহীদ শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাদের জেরা করেন শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।
এফএইচ/এমএএইচ/
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।