আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চাওয়ার ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের প্রায় সব প্রতিবেশী দেশ একসঙ্গে অবস্থান নিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্য সফরের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মারের পাশে বসে ট্রাম্প বলেন, আমরা বাগরাম ঘাঁটি তালেবানের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম বিনা মূল্যে। আমরা সেই ঘাঁটি ফেরত চাই।
দুই দিন পর তিনি সামাজিক মাধ্যমে হুমকি দেন, যদি আফগানিস্তান বাগরাম ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রকে না ফেরায়, তবে খারাপ কিছু ঘটবে।
তালেবান তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে জানায়, কোনো অবস্থাতেই আফগান জনগণ বাগরাম ঘাঁটি কোনো বিদেশি শক্তির হাতে তুলে দেবে না।
২০২১ সালে কাবুল দখলের পর থেকে তালেবান আফগানিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
গত মঙ্গলবার রাশিয়ার মস্কোতে অনুষ্ঠিত সপ্তম ‘মস্কো ফরম্যাট পরামর্শ বৈঠকে’ রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইরান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তানের কর্মকর্তারা তালেবানের সঙ্গে একমত হয়ে ঘোষণা দেন যে আফগানিস্তানে বা আশপাশের অঞ্চলে কোনো বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়।
এই ঘোষণা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকেই লক্ষ্য করে দেওয়া হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
ভারত ও পাকিস্তান বহুদিন ধরে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত।
ইরান সন্দেহ করে পাকিস্তানি উপস্থিতি নিয়ে, আবার মধ্য এশিয়ার দেশগুলো আশঙ্কা করে—আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা তাদের সীমান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তবু এই দেশগুলো এখন এক কণ্ঠে বলছে যে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা আঞ্চলিক দায়িত্ব, বাইরের কারোর নয়।
কাবুল থেকে মাত্র ৪৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্মাণ করেছিল।
এটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পুনর্বিন্যাসের নীতিতে আফগানিস্তানে ফেরত যাওয়ার বাস্তব পরিকল্পনা নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, মস্কোর এই বৈঠক রাশিয়ার জন্য একটি সুযোগ তৈরি করেছে- যেখানে তারা প্রমাণ করতে চায়, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেও মধ্য এশিয়ায় তাদের প্রভাব এখনো টিকে আছে।
তবে শুধু রাশিয়া নয়—চীন, ইরান, পাকিস্তান, এমনকি ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রত্যাবর্তনকে অস্বস্তিকর হিসেবে দেখছে।
কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি মানে সরাসরি মার্কিন-রুশ-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফ্রন্টলাইনে পড়া।
তাদের মতে, আঞ্চলিক সংগঠন যেমন মস্কো ফরম্যাট বা শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা নিরাপত্তা ও বাণিজ্যে সহযোগিতার জন্য অনেক বেশি উপযোগী।
আঞ্চলিক বিশ্লেষক তৈমুর খান বলেন, তারা আশঙ্কা করছে, আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি গোয়েন্দা অভিযান, অস্থিতিশীলতা এবং প্রক্সি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ইব্রাহিম বাহিস বলেন, বাগরাম ঘাঁটি ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন উঠলেই তালেবান নিজেদের জনসমর্থন হারাবে।
অন্যদিকে, তালেবান জানে—দেশের অর্থনীতি ও প্রশাসন পুনরুদ্ধারে তাদের পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সংলাপ ও নিষেধাজ্ঞা শিথিলতার প্রয়োজন।
বাগরাম ঘাঁটি চীনের সীমান্ত থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে।
ট্রাম্প একে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র কারখানার কাছাকাছি একটি কৌশলগত অবস্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বাগরাম ইস্যুটি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একধরনের বার্তা—তারা এখনো অঞ্চলে প্রভাব বজায় রাখতে চায়।
২০২১ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর তালেবান আন্তর্জাতিকভাবে পুরোপুরি স্বীকৃতি না পেলেও এখন প্রায় সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কার্যকর কূটনৈতিক যোগাযোগ গড়ে তুলেছে।
রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, পাকিস্তান দূতাবাসের পর্যায় উন্নীত করেছে, আর ভারতও প্রথমবারের মতো তালেবান প্রতিনিধিকে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
উরুমচি-ভিত্তিক গবেষক কুয়াত আকিজানভ বলেন, এটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক যোগাযোগ।
সবাই বুঝেছে, আফগানিস্তানকে বিচ্ছিন্ন রাখলে কেউই লাভবান হবে না।
সূত্র: আল-জাজিরা
এমএসএম
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।
এডমিন 












