০৪:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আবরাহার হস্তিবাহিনীর অলৌকিক ধ্বংসের কাহিনি

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ১২:০৬:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
  • 10

মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করার বছরটি আরবে প্রসিদ্ধ ছিল আমুল ফীল বা হাতির বছর হিসেবে। কারণ ওই বছর হাবাশার বাদশাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত ইয়েমেনের শাসনকর্তা আবরাহা আল-আশরাম হাবশী তার বিশাল হাতির বহর ও সেনাবাহিনী নিয়ে আল্লাহর ঘর কাবা ধ্বংস করতে আসেন এবং আল্লাহ তাআলা পাখির ঝাঁক পাঠিয়ে তাদের ধ্বংস করে দেন।

হস্তীবাহিনীর কাবা আক্রমণের এই ঘটনা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তুমি কি দেখনি, তোমার রব হাতিওয়ালাদের সঙ্গে কী করেছিলেন? তিনি কি তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেননি? আর তিনি তাদের বিরুদ্ধে পাঠালেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, যারা তাদের ওপর নিক্ষেপ করছিল পোড়া মাটির পাথর, ফলে তিনি তাদের করলেন ভক্ষিত তৃণ-ভুষির মত। (সুরা ফীল: ১–৫)

খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আবরাহার কাবা আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল ৫৭০ বা ৫৭১ খৃষ্টাব্দে। তবে আবরাহার অন্তরে কাবার প্রতি ঈর্ষা ও শত্রুতা জন্ম নিয়েছিল আরও কয়েক বছর আগে।

আবরাহার ক্ষোভের মূল কারণ ছিল কাবার প্রতি মানুষের অনন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। হজের মৌসুমে প্রতি বছর আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ হজ পালন করতে মক্কায় যেত। ইয়েমেন থেকেও অনেকে যেত। আবরাহার এটা পছন্দ হত না। তিনি বুঝতে পারতেন না এই ঘরের এমন কী মাহাত্ম আছে যে কারণে এত মানুষ মক্কায় যাচ্ছে!

এক পর্যায়ে তিনি ভাবেন, তিনি যদি ইয়েমেনে কাবার চেয়ে বড় একটা  গির্জা নির্মাণ করেন, তাহলে মানুষ হয়ত দলে দলে তার গির্জায়ও আসবে। এই চিন্তা থেকে তিনি ইয়েমেনে একটি বড় গির্জা নির্মাণ করেন এবং ইয়েমেনসহ আরবের সবাইকে ইয়েমেনের ওই গির্জায় এসে হজ পালন করার আহ্বান জানান।

কিন্তু তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে খু্ব বেশি মানুষ ইয়েমেনের ওই গির্জায় হজ পালন করতে গেল না। কাবার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও ভালোবাসা কমল না। হজের মৌসুমে ঠিকই দলে দলে মানুষ কাবার দিকে ছুটল। উপরন্তু আরবের কিছু মানুষ একবার অসম্মান করার জন্য তার গির্জাকে মল দিয়ে নোংরা করল।

ফলে আবরাহার মনে জেদ চাপল যে তিনি এর একটা শেষ দেখে ছাড়বেন। মানুষের কাবায় যাওয়া যেহেতু বন্ধ হচ্ছে না, আবার কাবাকে সমর্থন করতে গিয়ে তার গির্জাকে অসম্মান করা হচ্ছে, তাই ওই কাবাই তিনি ধ্বংস করে দেবেন।

এই সংকল্পে আবরাহা ষাট হাজার অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তিনি নিজে একটি শক্তিশালী হস্তীর পিঠে আরোহণ করলেন। সৈন্যদের সাথে ছিল আরও আটটি অথবা বারটি হাতি।

আবরাহা ইয়েমেন থেকে এগিয়ে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল পাড়ি দিয়ে যখন মক্কার নিকটবর্তী উপত্যকা মুহাসসারে পৌঁছলেন তখন তার হাতি মাটিতে বসে পড়ল। কাবার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোনোভাবেই তাকে ওঠানো সম্ভব হল না। অথচ উত্তর, দক্ষিণ কিংবা পূর্ব দিকে যাওয়ার জন্য ওঠানোর চেষ্টা করলে হাতিটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দৌঁড়াতে শুরু করত।

কিন্তু আবরাহা কাবা ধ্বংস না করে ফিরে যেতে প্রস্তুত ছিল না। সে তার হাতিটিকে মেরে পিটিয়ে যে কোনোভাবে কাবার দিকে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। এ সময়ে আল্লাহ তা‘আলা এক ঝাঁক ছোট ছোট পাখি পাঠালেন। সেই পাখির ঝাঁক আবরাহার সেনাবাহিনীর ওপর পাথরের ছোট ছোট টুকরো নিক্ষেপ করতে লাগল। প্রত্যেকটি পাখি তিনটি করে পাথরের টুকরো বা কংকর নিয়ে আসত একটি ঠোঁটে এবং দুইটি দু’পায়ে। কংকরগুলোর আকার আয়তন ছিল ছোলার দানার মত। কিন্তু কংকরগুলো যার যে অঙ্গে লাগত সেই অঙ্গ ফেটে রক্ত প্রবাহিত হতে হতে সে মরে যেত।

আবরাহার সেনাবাহিনীর সবার গায়ে কংকর লেগেছিল তা নয়। কিন্তু এ অলৌকিক ঘটনায় তার পুরো বাহিনীই ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে পড়ে এবং প্রাণভয়ে পলায়নের উদ্দেশ্যে যখন বেপরোয়াভাবে ছুটাছুটি শুরু করে তখন হাতি, ঘোড়া ও মানুষের পদতলে পিষ্ট হয়ে অনেকেই মারা যায়। পাখির কংকরের আঘাতেও বহু সৈন্য প্রাণ হারায়।

আবরাহা পালিয়ে ইয়েমেনে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার আজাব তাকে বিশেষভাবে পাকড়াও করে। আল্লাহ তাআলার নির্দেশে তার হাঁড়ের জোড়াগুলো খুলে যেতে থাকে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে বহু কষ্টে তিনি ইয়েমেনের সানায় পৌঁছেন। সেখানে তার বুক বিদীর্ণ হয়ে যায়, হৃৎপিন্ড বেরিয়ে আসে এবং তিনি মারা যান।

হাতির বহরসহ আবরাহার বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার ক্ষমতা মক্কাবাসীর ছিল না। আবরাহার মক্কার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে আল্লাহর ঘরের নিরাপত্তার দায়িত্ব আল্লাহর হাতে ন্যাস্ত করে মক্কার মানুষ মক্কার আশেপাশের এলাকা ও পাহাড়গুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। আবরাহা ও তার বাহিনীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার খবর শুনে তারা মক্কায় নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে আসে।

এই বিস্ময়কর ঘটনা পুরো আরবে ও আরবের বাইরে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। কাবার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়। আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার অসীম ক্ষমতার ওপর বিশ্বাসও বেড়ে যায়।

এই ঘটনার কিছুদিন পর মক্কায় হজরত মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্ম হয়। যিনি পরবর্তীতে আল্লাহর শেষ নবী হিসেবে প্রেরিত হন এবং কাবা হয় তার প্রচারিত আল্লাহ তাআলার শেষ ও চূড়ান্ত ধর্ম ইসলামের একমাত্র কিবলা।

ওএফএফ

ট্যাগঃ

আবরাহার হস্তিবাহিনীর অলৌকিক ধ্বংসের কাহিনি

আপডেট সময়ঃ ১২:০৬:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করার বছরটি আরবে প্রসিদ্ধ ছিল আমুল ফীল বা হাতির বছর হিসেবে। কারণ ওই বছর হাবাশার বাদশাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত ইয়েমেনের শাসনকর্তা আবরাহা আল-আশরাম হাবশী তার বিশাল হাতির বহর ও সেনাবাহিনী নিয়ে আল্লাহর ঘর কাবা ধ্বংস করতে আসেন এবং আল্লাহ তাআলা পাখির ঝাঁক পাঠিয়ে তাদের ধ্বংস করে দেন।

হস্তীবাহিনীর কাবা আক্রমণের এই ঘটনা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তুমি কি দেখনি, তোমার রব হাতিওয়ালাদের সঙ্গে কী করেছিলেন? তিনি কি তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেননি? আর তিনি তাদের বিরুদ্ধে পাঠালেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, যারা তাদের ওপর নিক্ষেপ করছিল পোড়া মাটির পাথর, ফলে তিনি তাদের করলেন ভক্ষিত তৃণ-ভুষির মত। (সুরা ফীল: ১–৫)

খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আবরাহার কাবা আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল ৫৭০ বা ৫৭১ খৃষ্টাব্দে। তবে আবরাহার অন্তরে কাবার প্রতি ঈর্ষা ও শত্রুতা জন্ম নিয়েছিল আরও কয়েক বছর আগে।

আবরাহার ক্ষোভের মূল কারণ ছিল কাবার প্রতি মানুষের অনন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। হজের মৌসুমে প্রতি বছর আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ হজ পালন করতে মক্কায় যেত। ইয়েমেন থেকেও অনেকে যেত। আবরাহার এটা পছন্দ হত না। তিনি বুঝতে পারতেন না এই ঘরের এমন কী মাহাত্ম আছে যে কারণে এত মানুষ মক্কায় যাচ্ছে!

এক পর্যায়ে তিনি ভাবেন, তিনি যদি ইয়েমেনে কাবার চেয়ে বড় একটা  গির্জা নির্মাণ করেন, তাহলে মানুষ হয়ত দলে দলে তার গির্জায়ও আসবে। এই চিন্তা থেকে তিনি ইয়েমেনে একটি বড় গির্জা নির্মাণ করেন এবং ইয়েমেনসহ আরবের সবাইকে ইয়েমেনের ওই গির্জায় এসে হজ পালন করার আহ্বান জানান।

কিন্তু তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে খু্ব বেশি মানুষ ইয়েমেনের ওই গির্জায় হজ পালন করতে গেল না। কাবার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও ভালোবাসা কমল না। হজের মৌসুমে ঠিকই দলে দলে মানুষ কাবার দিকে ছুটল। উপরন্তু আরবের কিছু মানুষ একবার অসম্মান করার জন্য তার গির্জাকে মল দিয়ে নোংরা করল।

ফলে আবরাহার মনে জেদ চাপল যে তিনি এর একটা শেষ দেখে ছাড়বেন। মানুষের কাবায় যাওয়া যেহেতু বন্ধ হচ্ছে না, আবার কাবাকে সমর্থন করতে গিয়ে তার গির্জাকে অসম্মান করা হচ্ছে, তাই ওই কাবাই তিনি ধ্বংস করে দেবেন।

এই সংকল্পে আবরাহা ষাট হাজার অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তিনি নিজে একটি শক্তিশালী হস্তীর পিঠে আরোহণ করলেন। সৈন্যদের সাথে ছিল আরও আটটি অথবা বারটি হাতি।

আবরাহা ইয়েমেন থেকে এগিয়ে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল পাড়ি দিয়ে যখন মক্কার নিকটবর্তী উপত্যকা মুহাসসারে পৌঁছলেন তখন তার হাতি মাটিতে বসে পড়ল। কাবার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোনোভাবেই তাকে ওঠানো সম্ভব হল না। অথচ উত্তর, দক্ষিণ কিংবা পূর্ব দিকে যাওয়ার জন্য ওঠানোর চেষ্টা করলে হাতিটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দৌঁড়াতে শুরু করত।

কিন্তু আবরাহা কাবা ধ্বংস না করে ফিরে যেতে প্রস্তুত ছিল না। সে তার হাতিটিকে মেরে পিটিয়ে যে কোনোভাবে কাবার দিকে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। এ সময়ে আল্লাহ তা‘আলা এক ঝাঁক ছোট ছোট পাখি পাঠালেন। সেই পাখির ঝাঁক আবরাহার সেনাবাহিনীর ওপর পাথরের ছোট ছোট টুকরো নিক্ষেপ করতে লাগল। প্রত্যেকটি পাখি তিনটি করে পাথরের টুকরো বা কংকর নিয়ে আসত একটি ঠোঁটে এবং দুইটি দু’পায়ে। কংকরগুলোর আকার আয়তন ছিল ছোলার দানার মত। কিন্তু কংকরগুলো যার যে অঙ্গে লাগত সেই অঙ্গ ফেটে রক্ত প্রবাহিত হতে হতে সে মরে যেত।

আবরাহার সেনাবাহিনীর সবার গায়ে কংকর লেগেছিল তা নয়। কিন্তু এ অলৌকিক ঘটনায় তার পুরো বাহিনীই ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে পড়ে এবং প্রাণভয়ে পলায়নের উদ্দেশ্যে যখন বেপরোয়াভাবে ছুটাছুটি শুরু করে তখন হাতি, ঘোড়া ও মানুষের পদতলে পিষ্ট হয়ে অনেকেই মারা যায়। পাখির কংকরের আঘাতেও বহু সৈন্য প্রাণ হারায়।

আবরাহা পালিয়ে ইয়েমেনে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার আজাব তাকে বিশেষভাবে পাকড়াও করে। আল্লাহ তাআলার নির্দেশে তার হাঁড়ের জোড়াগুলো খুলে যেতে থাকে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে বহু কষ্টে তিনি ইয়েমেনের সানায় পৌঁছেন। সেখানে তার বুক বিদীর্ণ হয়ে যায়, হৃৎপিন্ড বেরিয়ে আসে এবং তিনি মারা যান।

হাতির বহরসহ আবরাহার বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার ক্ষমতা মক্কাবাসীর ছিল না। আবরাহার মক্কার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে আল্লাহর ঘরের নিরাপত্তার দায়িত্ব আল্লাহর হাতে ন্যাস্ত করে মক্কার মানুষ মক্কার আশেপাশের এলাকা ও পাহাড়গুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। আবরাহা ও তার বাহিনীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার খবর শুনে তারা মক্কায় নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে আসে।

এই বিস্ময়কর ঘটনা পুরো আরবে ও আরবের বাইরে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। কাবার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়। আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার অসীম ক্ষমতার ওপর বিশ্বাসও বেড়ে যায়।

এই ঘটনার কিছুদিন পর মক্কায় হজরত মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্ম হয়। যিনি পরবর্তীতে আল্লাহর শেষ নবী হিসেবে প্রেরিত হন এবং কাবা হয় তার প্রচারিত আল্লাহ তাআলার শেষ ও চূড়ান্ত ধর্ম ইসলামের একমাত্র কিবলা।

ওএফএফ