০৭:৩৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আগামীর নিরাপদ খাদ্যে টেকসই কৃষির গুরুত্ব

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ১২:০২:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
  • 10

প্রফেসর নোমান ফারুক ও সমীরণ বিশ্বাস

২০২৫ সালে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন সূত্রে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭৫.৭  মিলিয়ন ধরা হয়েছে। তবে ২০৫০ সালের জনসংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ তা নির্ভর করে জন্মহার, মৃত্যুহার, অভিবাসন, জনসংখ্যা গতি ও সামাজিক পরিবর্তনগুলোর ওপর। একটি জনপ্রিয় পূর্বাভাস অনুসারে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২১৪.৭ মিলিয়ন হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক্স অনুযায়ী, ২০৫০ সালের দিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২১৪ মিলিয়নের দিকে যেতে পারে। ইউএনএফপিএ বলেছে, যদি বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৫৩ সালে শীর্ষে পৌঁছতে পারে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির ধীরগতি এবং সমীকরণগত সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০৫০ সালের জনসংখ্যা একাধিক ‘উচ্চ-স্বল্পতার’ মডেলের বাইরে সম্ভাব্য নয়।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাসের কারণ

জন্মহার: বাংলাদেশে জন্মহার গত কয়েক দশকে ক্রমহ্রাস পাচ্ছে। যদি জন্মহার দ্রুত নেমে আসে (পুরুষ-নারী গড়ে দুই বা এর কম সন্তান), তাহলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি ধীরে যেতে পারে। অন্যদিকে, যদি উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ব্যাহত হয়, জন্মহার আবার ওপরের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

মৃত্যুহার ও স্বাস্থ্যসেবা: স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, শিশুমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। রোগ-প্রতিরোধ, খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যসচেতনতা এসব পরিবর্তন জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে সীমাবদ্ধ করতে পারে।

অভিবাসন: অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর (গ্রাম থেকে শহরে), দেশান্তরী অভিবাসন—সব মিলিয়ে জনসংখ্যার বণ্টনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। যদি বিদেশে নির্যাস বেশি হয়, তা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

জনসংখ্যার গতি: একটি দেশে যদি একটি বড় যুব‐সমষ্টি থাকে, যারা সন্তান উৎপাদনের বয়সে উপনীত হবে, তাহলে ভবিষ্যতের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ‘মোমেন্টাম’ কাজ করে। অর্থাৎ যদিও জন্মহার কমে আসুক, সেই যুবগোষ্ঠী জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।

শিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা: শিক্ষার প্রসারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে পরিবার-পরিকল্পনার ব্যবহার বাড়বে, ফলে জন্মহার আরও নিয়ন্ত্রিত হবে। অর্থনৈতিক উত্তরণের সঙ্গে সাধারণত পরিবার ছোট করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব: বন্যা, রূপান্তরিত কৃষিজমি, মেঘলা আবহাওয়া, উপকূলীয় ক্ষয়, জমি অভিগম্যতা হ্রাস ইত্যাদি কারণে কিছু অঞ্চলের জনসংখ্যা বাসযোগ্য পরিবেশ কম পাবে। ফলে অভিবাসন বা পুনর্বাসন ঘটতে পারে, যা জনসংখ্যার ঘনত্ব ও গঠনকে প্রভাবিত করবে।

নগরায়ন: গ্রামের মানুষের শহরে আগমন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়। শহুরে সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত, কাজের সুযোগ বেশি হওয়ায় মানুষ শহরে যেতে আগ্রহী হবে। তবে শহুরে পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা জনসংখ্যার চাপ তৈরি করতে পারে।

নীতি ও পরিকল্পনা প্রভাব: সরকার ও নীতিনির্ধারকরা জনসংখ্যা চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নগর পরিকল্পনায় যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রিত রাখার সুযোগ থাকবে। যেমন: পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, গৃহীত জনসংখ্যা নীতিমালা ইত্যাদি।

চ্যালেঞ্জ: জমি ও অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা মেলে ধরতে অবকাঠামোর চাপ বাড়বে (বাসস্থান, পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ)। খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির চাহিদা, কৃষিজমি হ্রাস, পরিবেশ পরিবর্তন। পরিবেশ ও পরিবর্তন, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা। স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবার চাহিদা, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, পরিবহন সরঞ্জাম, কর্মসংস্থান। বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৃদ্ধদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবৃদ্ধি। নগর ব্যবস্থাপনা, যানজট, আবাসন সংকট, বস্তিবাসী সম্প্রসারণ।

কৃষি জমি হ্রাস: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি প্রকল্প অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কৃষিজমি প্রায় ১.৯৮ শতাংশ কমেছে। এর অর্থ, কৃষিজমির আয়তন প্রায় ৭৪,৩৮৮ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে ৭২,৯১৬ বর্গকিলোমিটারে এসেছে। প্রতি বছর প্রায় ২,৫০০-৩,০০০ হেক্টর চাষযোগ্য জমি নন-কৃষি কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া ২০০৮-২০১৯ সালের কৃষি তালিকানুসারে প্রায় ৪ লাখ একর কৃষিজমি দশকের মধ্যে নন-চাষযোগ্য বা অন্য কাজে রূপান্তরিত হয়েছে। কৃষিজমি হ্রাসে নগরায়ন, শিল্পায়ন, ভবন ও অবকাঠামো সম্প্রসারণ, অনিয়ন্ত্রিত জমির ব্যবহার ইত্যাদি প্রধান কারণ।

সুযোগ: যদি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫-৬৪ বছর) সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো যায়। তাহলে অর্থনীতি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ উৎপাদন, সেবা, প্রযুক্তি খাতে বৃহৎ বাজার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বড় বাজার, দেশজ উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি। উন্নত মানবসম্পদ বিনিয়োগ, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘ মেয়াদে যে সুদ পাওয়া যাবে, তা ব্যাপক হবে।

আরও পড়ুন
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের করণীয়
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ কীটনাশক

খাদ্য নিরাপত্তা: খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, প্রত্যেক মানুষের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্যে সব সময় শারীরিক ও অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার থাকা। যা একজন সক্রিয় ও সুস্থ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন। মূল উপাদান চারটি: উপলব্ধতা; পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ। প্রবেশযোগ্যতা; মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা খাদ্য পেতে সক্ষমতা। ব্যবহার; খাদ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ ও পুষ্টি ব্যবহারের সক্ষমতা। স্থিতিশীলতা; দীর্ঘমেয়াদে এসব উপাদানের নিরবচ্ছিন্নতা। খাদ্য নিরাপত্তা শুধু খাদ্যের পরিমাণ বা সরবরাহ নয় বরং মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বাজারব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ বা বৈশ্বিক সংকট খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

পুষ্টি নিরাপত্তা: পুষ্টি নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হওয়া। যাতে তারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে ও জীবনযাপন করতে পারে। শুধু যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য খাওয়াই যথেষ্ট নয়, সুষম খাদ্য খেতে হবে। খাদ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ উপাদান, ক্যালরি ইত্যাদির সঠিক ভারসাম্য থাকা চাই। পুষ্টি নিরাপত্তা খাদ্য নিরাপত্তার একটি উন্নত ধাপ। খাদ্য আছে মানেই পুষ্টি নিশ্চিত নয়। দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, খাদ্যাভ্যাস, মাতৃশিক্ষা–এসব পুষ্টি নিরাপত্তার বড় প্রভাবক। অপুষ্টি শিশুমৃত্যু, খর্বতা, দুর্বল এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ।

নিরাপদ খাদ্য: নিরাপদ খাদ্য হলো এমন খাদ্য, যা কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক, জীবাণু, কীটনাশক বা ভেজাল পদার্থ মুক্ত এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। নিরাপদ খাদ্য না হলে, তা পুষ্টি বা খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েও ক্ষতিপূরণ হয় না। খাদ্যে বিষক্রিয়া, খাদ্যবাহিত রোগ, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় খাদ্য আছে, পুষ্টিও আছে কিন্তু তা নিরাপদ নয়, যা পুরো ব্যবস্থা ব্যর্থ করে দিতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল, সংরক্ষণের ত্রুটি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, সবই খাদ্যকে অনিরাপদ করে। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে তিনটি স্তম্ভ; খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য একসাথে নিশ্চিত করতে হবে। শুধু খাদ্য সরবরাহ নয় বরং মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভিগম্যতা প্রয়োজন। সরকার, সমাজ এবং ব্যক্তি সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটি সম্ভব নয়।

এলডিসি

‘এলডিসি ২৪ নভেম্বর ২০২৬’ কথাটির অর্থ হলো ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা থেকে ২৪ নভেম্বর ২০২৬ তারিখে উত্তরণ করা হবে। ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ হলো এমন একটি দেশ যেখানকার অর্থনীতি, মানবসম্পদ, অবকাঠামো প্রভৃতিতে উন্নয়ন উচ্চমাত্রায় পৌঁছায়নি। জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচক (আয়, মানব উন্নয়ন সূচক, অবকাঠামো ইত্যাদি) বিবেচনায় রেখে একটি দেশকে এলডিসি ঘোষণা করে। এলডিসি মর্যাদা পাওয়া দেশের জন্য বিশেষ সুবিধাদি দেওয়া হয়। জিডিপি সীমিত আয় থেকে রপ্তানি ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বা শুল্কহ্রাস সুবিধা, আন্তর্জাতিক সহায়তা, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কারিগরি সহায়তা ইত্যাদি।

বাংলাদেশের জন্য এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের নির্ধারিত তারিখ হিসেবে ২৪ নভেম্বর ২০২৬ নির্বাচন করা হয়েছে। অর্থাৎ যদি পারফরমেন্স ও প্রক্রিয়া সবকিছু মিলিয়ে পরিকল্পনা মতো এগোয়, রাতারাতি সেই দিনই বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা ত্যাগ করে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। এ ছাড়া ডব্লিউটিওর একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের মুহূর্ত থেকে পরবর্তী ৩ বছর একটি ‘সক্ষমতা রূপান্তর সুবিধা’ দেওয়া হবে। যাতে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা যায়। এর সম্ভাব্য প্রভাব বা চ্যালেঞ্জ হলো: শুল্ক সুবিধা হ্রাস বা বন্ধ, রপ্তানিতে চ্যালেঞ্জ, সাহায্য ও সহায়তা, নতুন মর্যাদা ও সুযোগ এবং চাপে প্রস্তুতি।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের জন্য যেমন কিছু ইতিবাচক সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনই কৃষি খাতসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য তা বড় চ্যালেঞ্জও বয়ে আনবে। বিশেষ করে কৃষিখাতে উপকরণ, যেমন- বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদির ওপর আমদানি কর ৬ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং কৃষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সরকারের প্রদত্ত কৃষি ভর্তুকি হ্রাস পেলে কৃষকদের সেচ, বীজ, সার, এবং যন্ত্রপাতির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হবে, যা তাদের উৎপাদন সক্ষমতাকে হ্রাস করতে পারে।

বর্তমান বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৃষিখাতে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস এবং আমদানি কর বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। কৃষকদের জন্য সরকারি ভর্তুকি যেমন- সার, বীজ, জ্বালানি ও সেচ ব্যবস্থার খরচ কমিয়ে কৃষি কার্যক্রমকে সহনশীল করে তোলে, তেমনই এসব ভর্তুকির অভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়, যা কৃষকের উৎপাদন আগ্রহ ও সক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। অপরদিকে আমদানি কর বৃদ্ধি দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে। এ পরিবর্তনগুলো শুধু মানব খাদ্য নয়, নন-হিউম্যান যেমন প্রাণিখাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

এ ছাড়া ডিজেল ও বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা আছে, যা সরাসরি ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এসব চ্যালেঞ্জ খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে প্রতি বছর কৃষিজমি কমে যাওয়া এবং ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটির বেশি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্যের চাহিদা ব্যাপকহারে বাড়বে, যা বর্তমানে যে কৃষি উৎপাদন অবকাঠামো আছে, তা দিয়ে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

এ প্রেক্ষাপটে এখনই সময় একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের। নীতি নির্ধারকদের উচিত, কৃষি উপকরণের কর হ্রাস, প্রযুক্তিনির্ভর টেকসই কৃষির প্রসার, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৃষকদের জন্য সরাসরি সহায়তা নিশ্চিত করা। তবেই ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি টেকসই করা সম্ভব হবে।

লেখক:
১. অধ্যাপক, শেরোবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও রেজিস্ট্রার্ড ট্রেইনার, গ্লোবালগ্যাপ
২. কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।

এসইউ/এমএস

ট্যাগঃ
জনপ্রিয় খবর

আগামীর নিরাপদ খাদ্যে টেকসই কৃষির গুরুত্ব

আপডেট সময়ঃ ১২:০২:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

প্রফেসর নোমান ফারুক ও সমীরণ বিশ্বাস

২০২৫ সালে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন সূত্রে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭৫.৭  মিলিয়ন ধরা হয়েছে। তবে ২০৫০ সালের জনসংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ তা নির্ভর করে জন্মহার, মৃত্যুহার, অভিবাসন, জনসংখ্যা গতি ও সামাজিক পরিবর্তনগুলোর ওপর। একটি জনপ্রিয় পূর্বাভাস অনুসারে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২১৪.৭ মিলিয়ন হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক্স অনুযায়ী, ২০৫০ সালের দিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২১৪ মিলিয়নের দিকে যেতে পারে। ইউএনএফপিএ বলেছে, যদি বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৫৩ সালে শীর্ষে পৌঁছতে পারে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির ধীরগতি এবং সমীকরণগত সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০৫০ সালের জনসংখ্যা একাধিক ‘উচ্চ-স্বল্পতার’ মডেলের বাইরে সম্ভাব্য নয়।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাসের কারণ

জন্মহার: বাংলাদেশে জন্মহার গত কয়েক দশকে ক্রমহ্রাস পাচ্ছে। যদি জন্মহার দ্রুত নেমে আসে (পুরুষ-নারী গড়ে দুই বা এর কম সন্তান), তাহলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি ধীরে যেতে পারে। অন্যদিকে, যদি উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ব্যাহত হয়, জন্মহার আবার ওপরের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

মৃত্যুহার ও স্বাস্থ্যসেবা: স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, শিশুমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। রোগ-প্রতিরোধ, খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যসচেতনতা এসব পরিবর্তন জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে সীমাবদ্ধ করতে পারে।

অভিবাসন: অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর (গ্রাম থেকে শহরে), দেশান্তরী অভিবাসন—সব মিলিয়ে জনসংখ্যার বণ্টনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। যদি বিদেশে নির্যাস বেশি হয়, তা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

জনসংখ্যার গতি: একটি দেশে যদি একটি বড় যুব‐সমষ্টি থাকে, যারা সন্তান উৎপাদনের বয়সে উপনীত হবে, তাহলে ভবিষ্যতের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ‘মোমেন্টাম’ কাজ করে। অর্থাৎ যদিও জন্মহার কমে আসুক, সেই যুবগোষ্ঠী জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।

শিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা: শিক্ষার প্রসারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে পরিবার-পরিকল্পনার ব্যবহার বাড়বে, ফলে জন্মহার আরও নিয়ন্ত্রিত হবে। অর্থনৈতিক উত্তরণের সঙ্গে সাধারণত পরিবার ছোট করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব: বন্যা, রূপান্তরিত কৃষিজমি, মেঘলা আবহাওয়া, উপকূলীয় ক্ষয়, জমি অভিগম্যতা হ্রাস ইত্যাদি কারণে কিছু অঞ্চলের জনসংখ্যা বাসযোগ্য পরিবেশ কম পাবে। ফলে অভিবাসন বা পুনর্বাসন ঘটতে পারে, যা জনসংখ্যার ঘনত্ব ও গঠনকে প্রভাবিত করবে।

নগরায়ন: গ্রামের মানুষের শহরে আগমন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়। শহুরে সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত, কাজের সুযোগ বেশি হওয়ায় মানুষ শহরে যেতে আগ্রহী হবে। তবে শহুরে পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা জনসংখ্যার চাপ তৈরি করতে পারে।

নীতি ও পরিকল্পনা প্রভাব: সরকার ও নীতিনির্ধারকরা জনসংখ্যা চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নগর পরিকল্পনায় যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রিত রাখার সুযোগ থাকবে। যেমন: পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, গৃহীত জনসংখ্যা নীতিমালা ইত্যাদি।

চ্যালেঞ্জ: জমি ও অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা মেলে ধরতে অবকাঠামোর চাপ বাড়বে (বাসস্থান, পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ)। খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির চাহিদা, কৃষিজমি হ্রাস, পরিবেশ পরিবর্তন। পরিবেশ ও পরিবর্তন, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা। স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবার চাহিদা, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, পরিবহন সরঞ্জাম, কর্মসংস্থান। বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৃদ্ধদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবৃদ্ধি। নগর ব্যবস্থাপনা, যানজট, আবাসন সংকট, বস্তিবাসী সম্প্রসারণ।

কৃষি জমি হ্রাস: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি প্রকল্প অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কৃষিজমি প্রায় ১.৯৮ শতাংশ কমেছে। এর অর্থ, কৃষিজমির আয়তন প্রায় ৭৪,৩৮৮ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে ৭২,৯১৬ বর্গকিলোমিটারে এসেছে। প্রতি বছর প্রায় ২,৫০০-৩,০০০ হেক্টর চাষযোগ্য জমি নন-কৃষি কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া ২০০৮-২০১৯ সালের কৃষি তালিকানুসারে প্রায় ৪ লাখ একর কৃষিজমি দশকের মধ্যে নন-চাষযোগ্য বা অন্য কাজে রূপান্তরিত হয়েছে। কৃষিজমি হ্রাসে নগরায়ন, শিল্পায়ন, ভবন ও অবকাঠামো সম্প্রসারণ, অনিয়ন্ত্রিত জমির ব্যবহার ইত্যাদি প্রধান কারণ।

সুযোগ: যদি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫-৬৪ বছর) সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো যায়। তাহলে অর্থনীতি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ উৎপাদন, সেবা, প্রযুক্তি খাতে বৃহৎ বাজার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বড় বাজার, দেশজ উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি। উন্নত মানবসম্পদ বিনিয়োগ, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘ মেয়াদে যে সুদ পাওয়া যাবে, তা ব্যাপক হবে।

আরও পড়ুন
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের করণীয়
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ কীটনাশক

খাদ্য নিরাপত্তা: খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, প্রত্যেক মানুষের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্যে সব সময় শারীরিক ও অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার থাকা। যা একজন সক্রিয় ও সুস্থ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন। মূল উপাদান চারটি: উপলব্ধতা; পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ। প্রবেশযোগ্যতা; মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা খাদ্য পেতে সক্ষমতা। ব্যবহার; খাদ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ ও পুষ্টি ব্যবহারের সক্ষমতা। স্থিতিশীলতা; দীর্ঘমেয়াদে এসব উপাদানের নিরবচ্ছিন্নতা। খাদ্য নিরাপত্তা শুধু খাদ্যের পরিমাণ বা সরবরাহ নয় বরং মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বাজারব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ বা বৈশ্বিক সংকট খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

পুষ্টি নিরাপত্তা: পুষ্টি নিরাপত্তা বলতে বোঝায়, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হওয়া। যাতে তারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে ও জীবনযাপন করতে পারে। শুধু যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য খাওয়াই যথেষ্ট নয়, সুষম খাদ্য খেতে হবে। খাদ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ উপাদান, ক্যালরি ইত্যাদির সঠিক ভারসাম্য থাকা চাই। পুষ্টি নিরাপত্তা খাদ্য নিরাপত্তার একটি উন্নত ধাপ। খাদ্য আছে মানেই পুষ্টি নিশ্চিত নয়। দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, খাদ্যাভ্যাস, মাতৃশিক্ষা–এসব পুষ্টি নিরাপত্তার বড় প্রভাবক। অপুষ্টি শিশুমৃত্যু, খর্বতা, দুর্বল এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ।

নিরাপদ খাদ্য: নিরাপদ খাদ্য হলো এমন খাদ্য, যা কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক, জীবাণু, কীটনাশক বা ভেজাল পদার্থ মুক্ত এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। নিরাপদ খাদ্য না হলে, তা পুষ্টি বা খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েও ক্ষতিপূরণ হয় না। খাদ্যে বিষক্রিয়া, খাদ্যবাহিত রোগ, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় খাদ্য আছে, পুষ্টিও আছে কিন্তু তা নিরাপদ নয়, যা পুরো ব্যবস্থা ব্যর্থ করে দিতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল, সংরক্ষণের ত্রুটি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, সবই খাদ্যকে অনিরাপদ করে। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে তিনটি স্তম্ভ; খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য একসাথে নিশ্চিত করতে হবে। শুধু খাদ্য সরবরাহ নয় বরং মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভিগম্যতা প্রয়োজন। সরকার, সমাজ এবং ব্যক্তি সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটি সম্ভব নয়।

এলডিসি

‘এলডিসি ২৪ নভেম্বর ২০২৬’ কথাটির অর্থ হলো ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা থেকে ২৪ নভেম্বর ২০২৬ তারিখে উত্তরণ করা হবে। ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ হলো এমন একটি দেশ যেখানকার অর্থনীতি, মানবসম্পদ, অবকাঠামো প্রভৃতিতে উন্নয়ন উচ্চমাত্রায় পৌঁছায়নি। জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচক (আয়, মানব উন্নয়ন সূচক, অবকাঠামো ইত্যাদি) বিবেচনায় রেখে একটি দেশকে এলডিসি ঘোষণা করে। এলডিসি মর্যাদা পাওয়া দেশের জন্য বিশেষ সুবিধাদি দেওয়া হয়। জিডিপি সীমিত আয় থেকে রপ্তানি ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বা শুল্কহ্রাস সুবিধা, আন্তর্জাতিক সহায়তা, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কারিগরি সহায়তা ইত্যাদি।

বাংলাদেশের জন্য এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের নির্ধারিত তারিখ হিসেবে ২৪ নভেম্বর ২০২৬ নির্বাচন করা হয়েছে। অর্থাৎ যদি পারফরমেন্স ও প্রক্রিয়া সবকিছু মিলিয়ে পরিকল্পনা মতো এগোয়, রাতারাতি সেই দিনই বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা ত্যাগ করে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। এ ছাড়া ডব্লিউটিওর একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের মুহূর্ত থেকে পরবর্তী ৩ বছর একটি ‘সক্ষমতা রূপান্তর সুবিধা’ দেওয়া হবে। যাতে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা যায়। এর সম্ভাব্য প্রভাব বা চ্যালেঞ্জ হলো: শুল্ক সুবিধা হ্রাস বা বন্ধ, রপ্তানিতে চ্যালেঞ্জ, সাহায্য ও সহায়তা, নতুন মর্যাদা ও সুযোগ এবং চাপে প্রস্তুতি।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের জন্য যেমন কিছু ইতিবাচক সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনই কৃষি খাতসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য তা বড় চ্যালেঞ্জও বয়ে আনবে। বিশেষ করে কৃষিখাতে উপকরণ, যেমন- বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদির ওপর আমদানি কর ৬ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং কৃষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সরকারের প্রদত্ত কৃষি ভর্তুকি হ্রাস পেলে কৃষকদের সেচ, বীজ, সার, এবং যন্ত্রপাতির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হবে, যা তাদের উৎপাদন সক্ষমতাকে হ্রাস করতে পারে।

বর্তমান বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৃষিখাতে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস এবং আমদানি কর বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। কৃষকদের জন্য সরকারি ভর্তুকি যেমন- সার, বীজ, জ্বালানি ও সেচ ব্যবস্থার খরচ কমিয়ে কৃষি কার্যক্রমকে সহনশীল করে তোলে, তেমনই এসব ভর্তুকির অভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়, যা কৃষকের উৎপাদন আগ্রহ ও সক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। অপরদিকে আমদানি কর বৃদ্ধি দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে। এ পরিবর্তনগুলো শুধু মানব খাদ্য নয়, নন-হিউম্যান যেমন প্রাণিখাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

এ ছাড়া ডিজেল ও বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা আছে, যা সরাসরি ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এসব চ্যালেঞ্জ খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে প্রতি বছর কৃষিজমি কমে যাওয়া এবং ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটির বেশি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্যের চাহিদা ব্যাপকহারে বাড়বে, যা বর্তমানে যে কৃষি উৎপাদন অবকাঠামো আছে, তা দিয়ে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

এ প্রেক্ষাপটে এখনই সময় একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের। নীতি নির্ধারকদের উচিত, কৃষি উপকরণের কর হ্রাস, প্রযুক্তিনির্ভর টেকসই কৃষির প্রসার, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৃষকদের জন্য সরাসরি সহায়তা নিশ্চিত করা। তবেই ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি টেকসই করা সম্ভব হবে।

লেখক:
১. অধ্যাপক, শেরোবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও রেজিস্ট্রার্ড ট্রেইনার, গ্লোবালগ্যাপ
২. কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।

এসইউ/এমএস