উম্মে হাবিবা কনা
‘জলবায়ু কন্যা’ নাম শুনেই খানিকটা আঁচ করতে পারা যায়, বইটি কী সম্পর্কে হতে পারে। বইটিতে তরু ও লতা যমজ ভাই-বোনের খুনসুঁটি দিয়ে শুরু হয়। দুজনই পড়াশোনায় ভালো। উপন্যাসের প্রায় শুরুতেই আমরা গার্লস স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষককে দেখতে পাই। যিনি দায়িত্ব পান বিতর্ক প্রতিযোগিতার। স্কুলে তিনি বিষয়টি জানান এবং বাছাই করেন কে কে থাকতে পারবে বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। বিতর্কের বিষয় নির্ধারিত হয়, ‘জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে করতে পারি শুধু আমরাই’। শিক্ষার্থীরা জলবায়ু বিষয় শুনে পিছিয়ে গেলেও কয়েকজন আগ্রহী নাম লেখায়। তারা দশম শ্রেণির লতা, ছন্দা ও মালা।
প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে ও ক্লাস শেষে ওরা জলবায়ু নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। বই-নোটস দেয় এবং সর্বোপরি একে অপরকে মনোবল জোগাতে থাকে। লতা তার নানুভাই সাঈদ সাহেবের কাছেও বলে জলবায়ু বিষয়ে জানার জন্য। এভাবে সে জানা-অজানা অনেক তথ্য পেয়ে যায়। উপন্যাসের শেষ অংশে দেখতে পাই, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। অবশেষে তথ্যবহুল বক্তব্য উপস্থাপন, যুক্তি প্রদর্শন ও খণ্ডন, ভাষার দক্ষতা, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি দেখে লতাকে শ্রেষ্ঠ বক্তা ঘোঘণা করে এবং তারা জয়লাভ করে।
উপন্যাসের চরিত্রায়ন আমার ভালো লেগেছে। কিশোরী লতা দশম শ্রেণির ছাত্রী। অজানাকে জানার, শেখার অদম্য একটা ইচ্ছাশক্তি আছে তার। পুরো উপন্যাসে তার মেধা, বাচনভঙ্গি, চঞ্চলতা, সাহসিকতা, ধৈর্যশীলতা, বন্ধুত্বপরায়নতা বজায় রেখেছে। তরু উপন্যাসের শুরুতে খুনসুঁটিতে মেতে থাকলেও পরে তাকে দায়িত্বশীল ভাই হিসেবেই দেখা যায়। তরু ও লতার নানা হচ্ছেন সাঈদ সাহেব। তিনি লতার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথা শুনে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। ফয়জুল ও নাজমা হলেন তরু ও লতার বাবা-মা। অন্য বাবা-মায়ের মতোই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনায় ছাড় দিতে রাজী নন।
মূলত উপন্যাসটি পড়া শুরু করি শেখার প্রত্যয় নিয়ে। ধরেই নিয়েছিলাম, জলবায়ু সম্পর্কিত খুঁটিনাটি প্রয়োজনীয় সব তথ্য জানতে পারবো। হয়েছেও তাই। চমৎকার একটি কিশোর উপন্যাস। প্রতিটি চরিত্র এত গোছালোভাবে সাজানো। নিঃসন্দেহে শিশু-কিশোর-বয়োবৃদ্ধ সবাই পছন্দ করবেন। কেননা কোনো চরিত্রই অপ্রয়োজনীয় মনে হবে না। পড়তে একঘেঁয়ে লাগবে না।
এ ছাড়া বিতর্ক প্রতিযোগিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি আর ভেবেছি, আমার কৈশোরে যদি এমন বান্ধবী পেতাম, যারা সাহস দেবে, বই দিয়ে, তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে। এমন টিচার যদি পেতাম, গর্ব করার মতো কাজ অবশ্যই আমিও করতে পারতাম। এমন সাপোর্টিভ বড় ভাই যদি পেতাম। শিক্ষকতুল্য নানুকে পেতাম। যিনি এতটা ফ্রেন্ডলি, ধৈর্য ধরে দক্ষতার সাথে তৈরি করলেন নাতনিকে। সত্যিই ধন্য হতাম। পড়ার সময় লতার জায়গায় নিজেকে দেখছিলাম। যেন আমি একজন সফল কিশোরী বিতার্কিক। যে পরিবেশ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে, পরিবেশকে ভালোবাসে এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মানতেই হবে, এই কিশোর-কিশোরীর হাত ধরেই আমরা সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারবো।
বইয়ের কিছু উল্লেখযোগ্য লাইন:
১. গল্পবাজ, গল্পবাজ বলছিস, যেদিন আমি থাকব না সেদিন বুঝবি গল্পবাজের কদর।
২. আমার সারাজীবনের সঞ্চিত সম্পদ দিয়ে আশেপাশের দশটি গ্রামে দশটি নলকূপ স্থাপন করে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার জন্য দান করে গেলাম।
৩. তোকে কেউ হারাতে পারবে না, বয়েজ স্কুল জিতলে বলবি আমাদের স্কুল জিতেছে আর গার্লস স্কুল জিতলে বলবি আমার বোন জিতেছে। তোর তো দুদিকেই জেতা।
৪. পৃথিবীর উপরিভাগের পানি যাকে আমরা সারফেস ওয়াটার বলি। মানুষকে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে পৃথিবীর উপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
৫. দেশের সব নদী গভীর করতে হবে, দু’পার উঁচু করে বাঁধ দিতে হবে, কিছুদূর পর পর নদী থেকে কৃত্রিম শাখা বের করে ড্রেন, সাব ড্রেন করে সেই পানি দিয়ে কৃষিকাজ করতে হবে।
৬. মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ধারণের একটা সীমা আছে, সেই সীমা অতিক্রম করলে তো মানুষ মারা যাবেই। এটা আগে ছিল না। ইদানীং শোনা যাচ্ছে হিটস্ট্রোকে মানুষ মারা যাচ্ছে। এটাও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে।
৭. সময় এসেছে সন্তানদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষার বাইরেও যে বিশাল জ্ঞানভান্ডার আছে, সন্তান লালন-পালনের উদ্দেশ্য যে শুধু সরকারি চাকরি করার জন্য নয় সেটা অনুধাবন করার। সন্তানদের শেখানোর সময় এসেছে লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়ার।
৮. দেশে অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই কিন্তু অ্যাকাডেমিক শিক্ষা আর প্রকৃত মানুষ বানানোর শিক্ষায় তফাত আছে তাই তো এখন প্রয়োজন মানুষ বানানোর শিক্ষা।
৯. প্রতিপক্ষকে কখনো দুর্বল ভাবতে নেই।
১০. ফুটপ্রিন্ট হলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে কার্বন নিঃসরণ, যেমন- আমরা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ফ্যান চালাই, পানির অপচয় করি, বিনা কারণে গাড়িতে চড়ে বেড়াই এতে করে কার্বন নিঃসরণ হয়।
১১. আমরা তো কার্বন নিঃসরণ করি মাত্র শতকরা জিরো পয়েন্ট ফোর সেভেন পার্সেন্ট।
১২. যদি মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরি না করে বিকল্প হিসেবে পাথরের ঢালাই সিমেন্টের ব্লক তৈরি করে বাড়ি-ঘর তৈরি করা হয় তবে কার্বন নিঃসরণ অনেক কম হবে।
তরু-লতা ভাই-বোনকে আমার ভালো লেগেছে। একটি সুন্দর শৈশব-কৈশোর দেখতে পেয়েছি ওদের মধ্যে। বইটির চরিত্রায়ন ও শব্দচয়ন বেশ ভালো লেগেছে। লতা একটি অন্যতম প্রধান সৃষ্টি জিল্লুর রহমানের। লতার মতো মেয়েদের হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাবে একদিন।
বইয়ের নাম: জলবায়ু কন্যা
লেখক: জিল্লুর রহমান
ধরন: কিশোর উপন্যাস
প্রকাশনী: অন্বেষা প্রকাশন
মলাট মূল্য: ২৭০ টাকা।
এসইউ/
এডমিন 














