০২:৪২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আসন্ন নির্বাচন এবং ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

  • এডমিন
  • আপডেট সময়ঃ ০৬:০০:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫
  • 3

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক উত্তাল সময় চলছে। এই নির্বাচন কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের দিকনির্দেশনা।

একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা দেশের জনগণের হলেও, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশটির স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের (World Bank) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সূচক ছিল -০.৯১ পয়েন্ট (যেখানে ২.৫ শক্তিশালী এবং -২.৫ দুর্বল স্থিতিশীলতা নির্দেশ করে), যা দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং নির্বাচনকালীন ঝুঁকির গুরুত্ব তুলে ধরে।

নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রভাব ফেলছে। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া সবসময়ই প্রতিবেশী ভারতের কাছে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। ভারত তার নিজস্ব নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার দেখতে চায়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ দমনে বাংলাদেশের সহযোগিতা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রধান উদ্বেগ হলো, এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি যেন ক্ষমতায় না আসে যারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে অথবা আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি প্রকল্পগুলোতে বাধা দিতে পারে।

২০১৫ সালে সম্পাদিত স্থল সীমান্ত চুক্তির (Land Boundary Agreement) মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতা আরও জোরদার হয়েছে, যা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগের একটি বড় অংশ প্রশমিত করেছে। তিস্তা জলবন্টন চুক্তি থেকে শুরু করে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলো নির্বাচনের আগে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা তৈরি করে রাখে। তবে, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেবল ভারতের সঙ্গেই নয়, বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন চীনের সঙ্গেও গভীর হয়েছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০১৬ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর ঢাকা সফরকালে প্রায় $২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, কর্ণফুলি টানেলসহ একাধিক মেগা প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন বাংলাদেশকে তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI)-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। চীনের এই অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্ব কিছুটা সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট অস্ত্র আমদানির প্রায় ৭২ শতাংশ এসেছে চীন থেকে, যা বাংলাদেশকে চীনের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের একটি প্রধান উৎস এবং চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র ক্রেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

নির্বাচনের প্রাক্কালে তাই বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যের প্রয়োজন দেখা যায়। একদিকে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের বিশাল পুঁজি এবং প্রযুক্তি অপরিহার্য; অন্যদিকে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বের জন্য ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাও জরুরি। এই দুই পরাশক্তির মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান এক ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে।

ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কেবল ভারত-চীন দ্বৈরথের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা শক্তি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশের ওপর তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব, যা বিশ্ব বাণিজ্যের একটি প্রধান সমুদ্রপথ, বাংলাদেশকে ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রে এনে দিয়েছে। তারা এই অঞ্চলে একটি উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক দেখতে চায়, যেখানে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন সুরক্ষিত থাকবে।

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেবল একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নয়; এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দূরদর্শী হতে হবে। জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে, প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে এবং সুশাসন নিশ্চিত করে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জিং সময়কে সুযোগে পরিণত করতে পারে এবং বিশ্ব মঞ্চে তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে।

আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে যে জোরালো বক্তব্য আসছে, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চায় বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, যা তাদের বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক এজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা নির্দিষ্ট ভিসা নীতি বা বাণিজ্য সুবিধা সম্পর্কিত আলোচনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে। যদিও এই চাপকে অনেকেই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, তবুও বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি প্রধান অংশ (প্রায় ৮০% এর বেশি) পশ্চিমা বাজার (EU, USA) নির্ভর হওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ধরে রাখার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বেগকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৪৫% গিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে (EU) এবং প্রায় ১৯% গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (USA)।

আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত, চীন এবং পশ্চিমা শক্তির ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বহুমুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই চাপের ফলে, রাজনৈতিক দলগুলোর উপর ‘জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে, যা নির্বাচনের প্রচারে বৈদেশিক নীতির সূক্ষ্ম ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবে।

অন্যদিকে, প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মানবিক সংকট যেন ভূ-রাজনৈতিক খেলার গুটিতে পরিণত না হয়, সেদিকেও রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। সামগ্রিকভাবে, আন্তর্জাতিক মহলের নিবিড় পর্যবেক্ষণের কারণে আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা বজায় রেখে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বহুমুখী আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হবে, যা আন্তর্জাতিক ঋণ এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আইএমএফ (IMF) জানুয়ারি ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জন্য $৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে, যা মূলত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (যা ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ প্রায় $২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল) এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে। এই ঋণের শর্তাবলি পূরণে ব্যর্থতা বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া থমকে গেলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) বার্ষিক গড়ে $২.৫ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে ছিল। এই বিনিয়োগ ধরে রাখতে এবং আরও আকৃষ্ট করতে নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা দূর করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম আমদানিতে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য পশ্চিমা শক্তিগুলোর, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, কৌশলগত উদ্বেগ বাড়িয়েছে। চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের প্রধান কারণ হলো কম খরচ, সহজ শর্তে ঋণ এবং রাজনৈতিক শর্তহীনতা (যেমন- গণতন্ত্র বা মানবাধিকারসংক্রান্ত শর্ত আরোপ না করা)। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সরবরাহকৃত কিছু সামরিক হার্ডওয়্যার (যেমন- কর্ভেট এবং ফাইটার জেট) নিয়ে মানের প্রশ্ন উঠেছে এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এর মেরামত ও যন্ত্রাংশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এই দুর্বলতা সত্ত্বেও, সামরিক খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা শুধু $৭৫ মিলিয়ন ডলারের মতো একটি ক্ষুদ্র পরিসরে সীমিত। এই সামরিক ভারসাম্যের অভাব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে পশ্চিমা কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে এবং নির্বাচন-পরবর্তী সরকারকে সামরিক ক্রয় এবং প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে আরও সতর্ক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং ভৌগোলিক অবস্থান এখন বৈশ্বিক কানেক্টিভিটি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (IPS)-এর কেন্দ্রে রয়েছে। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় প্রায় ৪৬,৪০০ বর্গ কিলোমিটার আঞ্চলিক জলসীমা এবং প্রায় ৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটার অর্থনৈতিক অঞ্চল দাবি করে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির মাধ্যমে এবং চীন তার BRI-এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে সড়ক, রেল ও বন্দর নেটওয়ার্কে যুক্ত করার প্রতিযোগিতা করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত ত্রিপুরা থেকে চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য বাণিজ্যের সময় কয়েক গুণ কমিয়ে দেবে। এই আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি প্রকল্পগুলির দ্রুত বাস্তবায়ন নির্বাচনের মাধ্যমে আসা স্থিতিশীল সরকারের ওপর নির্ভর করবে, কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এই কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পগুলির গতি কমিয়ে দিতে পারে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলির কূটনৈতিক চাপ বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হবে, যার ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) এর ‘Everything But Arms’ (EBA) সুবিধার অধীনে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস (GSP+) সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু মানবাধিকার, শ্রম অধিকার এবং গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না হলে এই সুবিধা লাভ করা কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক খাত (RMG) মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫% হওয়ায়, পশ্চিমা বাজার ধরে রাখতে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা এবং শ্রম সংস্কার আনা সরকারের জন্য আবশ্যিক হয়ে দাঁড়াবে।

নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ফোরামগুলোতে আরও সক্রিয় ও দৃশ্যমান ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে, বিমসটেক (BIMSTEC) ফোরামে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে পারে এবং সার্ক (SAARC)-এর দুর্বলতা দূর করতে সহায়ক হতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সমর্থন বজায় রাখা অপরিহার্য। যদিও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এই ১২ লাখ শরণার্থীর জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি ডলারের মানবিক সহায়তা প্রদান করে, তবুও প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য মিয়ানমারের উপর চীন ও ভারতের যৌথ কূটনৈতিক চাপ প্রয়োজন। নির্বাচনের মাধ্যমে আসা একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার আঞ্চলিক নেতৃত্ব ও কূটনীতির মাধ্যমে এই জটিল মানবিক ও ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

নির্বাচনের পর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে বহুমুখী আন্তর্জাতিক চাপ সামলানো। একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ কেবল তার নিজের জন্যই নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য। রাজনৈতিক অস্থিরতা কেবল অর্থনৈতিক অগ্রগতিকেই বাধাগ্রস্ত করে না, এটি বিদেশি হস্তক্ষেপের পথও খুলে দিতে পারে। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে (HDI) বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নতি (যা ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে) প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কত জরুরি। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ তৈরি করা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা বজায় রাখা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। ভৌগোলিক অবস্থান এদেশকে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে (Developed Country) পরিণত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার এটিকে ভারত মহাসাগরীয় ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দেশের ভেতরে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং স্বচ্ছ সুশাসন নিশ্চিত করা আবশ্যক। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা অপরিহার্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.২%, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি, তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা এই হারকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেবল একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নয়; এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দূরদর্শী হতে হবে। জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে, প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে এবং সুশাসন নিশ্চিত করে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জিং সময়কে সুযোগে পরিণত করতে পারে এবং বিশ্ব মঞ্চে তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে। দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা আশা করে, এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, যা এই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

লেখক : সিইও, ইটিসি ইভেন্টস লিমিটেড।

এইচআর/জেআইএম

ট্যাগঃ

শত কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে ২ ব্যক্তি আটক

আসন্ন নির্বাচন এবং ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

আপডেট সময়ঃ ০৬:০০:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক উত্তাল সময় চলছে। এই নির্বাচন কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের দিকনির্দেশনা।

একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা দেশের জনগণের হলেও, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশটির স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের (World Bank) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সূচক ছিল -০.৯১ পয়েন্ট (যেখানে ২.৫ শক্তিশালী এবং -২.৫ দুর্বল স্থিতিশীলতা নির্দেশ করে), যা দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং নির্বাচনকালীন ঝুঁকির গুরুত্ব তুলে ধরে।

নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রভাব ফেলছে। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া সবসময়ই প্রতিবেশী ভারতের কাছে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। ভারত তার নিজস্ব নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার দেখতে চায়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ দমনে বাংলাদেশের সহযোগিতা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রধান উদ্বেগ হলো, এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি যেন ক্ষমতায় না আসে যারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে অথবা আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি প্রকল্পগুলোতে বাধা দিতে পারে।

২০১৫ সালে সম্পাদিত স্থল সীমান্ত চুক্তির (Land Boundary Agreement) মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতা আরও জোরদার হয়েছে, যা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগের একটি বড় অংশ প্রশমিত করেছে। তিস্তা জলবন্টন চুক্তি থেকে শুরু করে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলো নির্বাচনের আগে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা তৈরি করে রাখে। তবে, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেবল ভারতের সঙ্গেই নয়, বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন চীনের সঙ্গেও গভীর হয়েছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০১৬ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর ঢাকা সফরকালে প্রায় $২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, কর্ণফুলি টানেলসহ একাধিক মেগা প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন বাংলাদেশকে তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI)-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। চীনের এই অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্ব কিছুটা সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট অস্ত্র আমদানির প্রায় ৭২ শতাংশ এসেছে চীন থেকে, যা বাংলাদেশকে চীনের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের একটি প্রধান উৎস এবং চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র ক্রেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

নির্বাচনের প্রাক্কালে তাই বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যের প্রয়োজন দেখা যায়। একদিকে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের বিশাল পুঁজি এবং প্রযুক্তি অপরিহার্য; অন্যদিকে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বের জন্য ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাও জরুরি। এই দুই পরাশক্তির মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান এক ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে।

ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কেবল ভারত-চীন দ্বৈরথের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা শক্তি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশের ওপর তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব, যা বিশ্ব বাণিজ্যের একটি প্রধান সমুদ্রপথ, বাংলাদেশকে ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রে এনে দিয়েছে। তারা এই অঞ্চলে একটি উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক দেখতে চায়, যেখানে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন সুরক্ষিত থাকবে।

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেবল একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নয়; এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দূরদর্শী হতে হবে। জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে, প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে এবং সুশাসন নিশ্চিত করে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জিং সময়কে সুযোগে পরিণত করতে পারে এবং বিশ্ব মঞ্চে তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে।

আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে যে জোরালো বক্তব্য আসছে, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চায় বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, যা তাদের বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক এজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা নির্দিষ্ট ভিসা নীতি বা বাণিজ্য সুবিধা সম্পর্কিত আলোচনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে। যদিও এই চাপকে অনেকেই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, তবুও বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি প্রধান অংশ (প্রায় ৮০% এর বেশি) পশ্চিমা বাজার (EU, USA) নির্ভর হওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ধরে রাখার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বেগকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৪৫% গিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে (EU) এবং প্রায় ১৯% গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (USA)।

আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত, চীন এবং পশ্চিমা শক্তির ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বহুমুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই চাপের ফলে, রাজনৈতিক দলগুলোর উপর ‘জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে, যা নির্বাচনের প্রচারে বৈদেশিক নীতির সূক্ষ্ম ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবে।

অন্যদিকে, প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মানবিক সংকট যেন ভূ-রাজনৈতিক খেলার গুটিতে পরিণত না হয়, সেদিকেও রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। সামগ্রিকভাবে, আন্তর্জাতিক মহলের নিবিড় পর্যবেক্ষণের কারণে আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা বজায় রেখে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বহুমুখী আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হবে, যা আন্তর্জাতিক ঋণ এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আইএমএফ (IMF) জানুয়ারি ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জন্য $৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে, যা মূলত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (যা ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ প্রায় $২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল) এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে। এই ঋণের শর্তাবলি পূরণে ব্যর্থতা বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া থমকে গেলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) বার্ষিক গড়ে $২.৫ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে ছিল। এই বিনিয়োগ ধরে রাখতে এবং আরও আকৃষ্ট করতে নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা দূর করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম আমদানিতে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য পশ্চিমা শক্তিগুলোর, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, কৌশলগত উদ্বেগ বাড়িয়েছে। চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের প্রধান কারণ হলো কম খরচ, সহজ শর্তে ঋণ এবং রাজনৈতিক শর্তহীনতা (যেমন- গণতন্ত্র বা মানবাধিকারসংক্রান্ত শর্ত আরোপ না করা)। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সরবরাহকৃত কিছু সামরিক হার্ডওয়্যার (যেমন- কর্ভেট এবং ফাইটার জেট) নিয়ে মানের প্রশ্ন উঠেছে এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এর মেরামত ও যন্ত্রাংশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এই দুর্বলতা সত্ত্বেও, সামরিক খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা শুধু $৭৫ মিলিয়ন ডলারের মতো একটি ক্ষুদ্র পরিসরে সীমিত। এই সামরিক ভারসাম্যের অভাব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে পশ্চিমা কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে এবং নির্বাচন-পরবর্তী সরকারকে সামরিক ক্রয় এবং প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে আরও সতর্ক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং ভৌগোলিক অবস্থান এখন বৈশ্বিক কানেক্টিভিটি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (IPS)-এর কেন্দ্রে রয়েছে। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় প্রায় ৪৬,৪০০ বর্গ কিলোমিটার আঞ্চলিক জলসীমা এবং প্রায় ৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটার অর্থনৈতিক অঞ্চল দাবি করে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির মাধ্যমে এবং চীন তার BRI-এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে সড়ক, রেল ও বন্দর নেটওয়ার্কে যুক্ত করার প্রতিযোগিতা করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত ত্রিপুরা থেকে চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য বাণিজ্যের সময় কয়েক গুণ কমিয়ে দেবে। এই আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি প্রকল্পগুলির দ্রুত বাস্তবায়ন নির্বাচনের মাধ্যমে আসা স্থিতিশীল সরকারের ওপর নির্ভর করবে, কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এই কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পগুলির গতি কমিয়ে দিতে পারে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলির কূটনৈতিক চাপ বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হবে, যার ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) এর ‘Everything But Arms’ (EBA) সুবিধার অধীনে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস (GSP+) সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু মানবাধিকার, শ্রম অধিকার এবং গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না হলে এই সুবিধা লাভ করা কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক খাত (RMG) মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫% হওয়ায়, পশ্চিমা বাজার ধরে রাখতে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা এবং শ্রম সংস্কার আনা সরকারের জন্য আবশ্যিক হয়ে দাঁড়াবে।

নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ফোরামগুলোতে আরও সক্রিয় ও দৃশ্যমান ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে, বিমসটেক (BIMSTEC) ফোরামে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে পারে এবং সার্ক (SAARC)-এর দুর্বলতা দূর করতে সহায়ক হতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সমর্থন বজায় রাখা অপরিহার্য। যদিও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এই ১২ লাখ শরণার্থীর জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি ডলারের মানবিক সহায়তা প্রদান করে, তবুও প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য মিয়ানমারের উপর চীন ও ভারতের যৌথ কূটনৈতিক চাপ প্রয়োজন। নির্বাচনের মাধ্যমে আসা একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার আঞ্চলিক নেতৃত্ব ও কূটনীতির মাধ্যমে এই জটিল মানবিক ও ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

নির্বাচনের পর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে বহুমুখী আন্তর্জাতিক চাপ সামলানো। একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ কেবল তার নিজের জন্যই নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য অপরিহার্য। রাজনৈতিক অস্থিরতা কেবল অর্থনৈতিক অগ্রগতিকেই বাধাগ্রস্ত করে না, এটি বিদেশি হস্তক্ষেপের পথও খুলে দিতে পারে। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে (HDI) বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নতি (যা ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে) প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কত জরুরি। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ তৈরি করা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা বজায় রাখা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। ভৌগোলিক অবস্থান এদেশকে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে (Developed Country) পরিণত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার এটিকে ভারত মহাসাগরীয় ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দেশের ভেতরে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং স্বচ্ছ সুশাসন নিশ্চিত করা আবশ্যক। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা অপরিহার্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.২%, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি, তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা এই হারকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেবল একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নয়; এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দূরদর্শী হতে হবে। জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে, প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে এবং সুশাসন নিশ্চিত করে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জিং সময়কে সুযোগে পরিণত করতে পারে এবং বিশ্ব মঞ্চে তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে। দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা আশা করে, এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, যা এই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

লেখক : সিইও, ইটিসি ইভেন্টস লিমিটেড।

এইচআর/জেআইএম