ভারতের আধুনিক ক্রিকেট ইতিহাসে যাদের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র নিঃসন্দেহে বিরাট কোহলি। একদিকে তিনি রানের যন্ত্র, অন্যদিকে তিনি এক অনন্য আবেগের প্রতীক। আজ এই ক্রিকেট কিংবদন্তির জন্মদিন। ৩৬ বছরে পা রাখলেন তিনি, যে বয়সে অনেকেই ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে ভাবেন, কোহলি তখনও মাঠে আগুন ঝরাচ্ছেন ব্যাট হাতে।

১৯৮৮ সালের এই দিনে দিল্লিতে জন্ম বিরাট কোহলির। বাবা প্রেম কোহলি ছিলেন একজন ফৌজদারি আইনজীবী, আর মা সরোজ কোহলি একজন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল বিরাটের। মাত্র ৯ বছর বয়সে ভর্তি হন ‘ওয়েস্ট দিল্লি ক্রিকেট একাডেমিতে, যেখানে কোচ রাজকুমার শর্মার তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তার ক্রিকেটের প্রাথমিক শিক্ষা।

২০০৬ সালে বিরাটের জীবনে আসে এক বড় ধাক্কা বাবার মৃত্যু। কিন্তু পরদিনই তিনি দিল্লির হয়ে মাঠে নেমেছিলেন। পিতার মৃত্যুর বেদনা ভুলে মাঠে নামা সেই কিশোরের চোখে তখন শুধুই এক স্বপ্ন ভারতের হয়ে খেলবেন, নিজের নামের পাশে রাখবেন ‘লিজেন্ড’ তকমা।

২০০৮ সালের আইসিসি আন্ডার-১৯ ওয়ার্ল্ড কাপ এ ভারতের অধিনায়ক হিসেবে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন বিরাট কোহলি। সেই টুর্নামেন্টই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। একই বছরের আগস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার।

প্রথম দিকের ইনিংসগুলো হয়তো খুব আলো ছড়াতে পারেনি, কিন্তু কোহলির ভেতরে লুকিয়ে ছিল নিজেকে প্রমাণ করার এক অদম্য প্রতিজ্ঞা। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলে ছিলেন তিনি। সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচেই করেন সেঞ্চুরি।

বিরাট কোহলি যেন ক্রিকেটের জন্যই জন্মেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত (২০২৫ পর্যন্ত) তার সংগ্রহ (ওয়ানডে: ১৩ হাজারের বেশি রান, ৪৭টি সেঞ্চুরি, টেস্ট: ৮ হাজারের বেশি রান, ২৯টি সেঞ্চুরি, টি-টোয়েন্টি: ৪ হাজারের বেশি রান, ১টি সেঞ্চুরি)

তিনি একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি তিন ফরম্যাটেই ৫০-এর ওপর গড় ধরে রেখেছেন দীর্ঘ সময়। রান তাড়া করার ক্ষেত্রে তো তিনি এককথায় ‘চেজ মাস্টার’। ভারত যতবার বড় লক্ষ্য তাড়া করেছে, কোহলি ততবারই ছিলেন সাফল্যের কেন্দ্রে।

২০১৭ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনির পর ভারতের নেতৃত্বভার নেন কোহলি। তার নেতৃত্বে ভারত টেস্ট র্যাংকিংয়ে টানা কয়েক বছর শীর্ষে ছিল। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয় এনে দেন ভারতকে, যা ছিল দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম বিদেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়।

তবে আগুনে মেজাজের জন্য যেমন সমালোচনার মুখে পড়েছেন, তেমনি দলের প্রতি নিখাদ নিবেদন ও মানসিক দৃঢ়তার জন্য প্রশংসাও কুড়িয়েছেন।

বিরাট কোহলি শুধু ব্যাট হাতে নয়, ক্রিকেটারদের জীবনধারাতেও এনেছেন এক ‘ফিটনেস রেভলিউশন’। তিনি ভেজিটেরিয়ান জীবনধারা গ্রহণ করে দেখিয়েছেন শক্তি ও স্ট্যামিনার জন্য নিরামিষ যথেষ্ট। তার অনুশাসন ও ফিটনেস অনুপ্রেরণা দিয়েছে নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের। আজকের অনেক তরুণ খেলোয়াড়ই কোহলির ফিটনেস রুটিন অনুসরণ করেন।

২০১৭ সালে বলিউড অভিনেত্রী আনুশকা শর্মার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বিরাট। তাদের কন্যা ভামিকা কোহলির জন্ম হয় ২০২১ সালে আর ছেলে অকায় এর জন্ম ২০২৪ সালে।

ব্যক্তিজীবনে তিনি যতটা নিবেদিত স্বামী ও বাবা, ততটাই নিবেদিত একজন সমাজকর্মীও। তার প্রতিষ্ঠিত বিরাট কোহলি ফাউন্ডেশন সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও প্রাণীদের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে।

২০২০ সালের পর থেকে কোহলির ব্যাটে কিছুটা খরা দেখা দেয়। ১ হাজার দিনেরও বেশি সময় কোনো আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি পাননি। অনেকেই ভেবেছিলেন ‘শেষ হয়ে গেছেন বিরাট কোহলি’। কিন্তু ২০২২ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে শতরান করে তিনি ফিরলেন রাজকীয় ভঙ্গিতে। প্রমাণ করলেন, চ্যাম্পিয়নরা কখনও হার মানে না, তারা শুধু ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে।

কোহলি আজ শুধু একজন ক্রিকেটার নন; তিনি এক প্রজন্মের রোল মডেল। তার পরিশ্রম, শৃঙ্খলা, আত্মবিশ্বাস ও মনোযোগ সবই শেখার মতো। তার ব্যাটিংয়ের পেছনে আছে এক দারুণ বার্তা ‘তুমি যতই প্রতিকূলতায় পড়ো, নিজের বিশ্বাস হারিও না।’

৩৬ বছরে পা রাখা বিরাট কোহলি এখনো থামার পাত্র নন। তার চোখে এখনো নতুন স্বপ্ন আরও রেকর্ড গড়া, ম্যাচ জেতা ও অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দেওয়া। ক্রিকেটের ইতিহাসে হয়তো আরও অনেক নাম আসবে, কিন্তু ‘বিরাট’ নামটি থাকবে এক আলাদা মর্যাদায়। কারণ তিনি শুধু খেলেন না, তিনি ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখেন।
জেএস/
এডমিন 







