সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা, প্রিয় গান, স্নিগ্ধ একটা দৃশ্য কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন লাইক — এই ছোট ছোট আনন্দের পেছনে কাজ করে মস্তিষ্কের এক বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ, নাম ডোপামিন।
ডোপামিন নামটি এখন অনেকের কাছেই পরিচিত, একে অনেকে বলেন ‘সুখের হরমোন’। কিন্তু এই ডোপামিনই কখনও কখনও আমাদের আসক্ত করে ফেলে, বদলে দেয় মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজ।
ডোপামিন কী এবং এর কাজ
ডোপামিন হলো একধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, অর্থাৎ মস্তিষ্কের কোষ থেকে কোষে বার্তা পাঠানোর রাসায়নিক। এটি মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম বা পুরস্কার প্রক্রিয়ার অংশ। যখন আমরা কিছু আনন্দদায়ক কাজ করি — যেমন প্রিয় খাবার খাওয়া বা প্রশংসা পাওয়া — তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসৃত হয়। এতে আমরা ভালো বোধ করি এবং একই কাজ আবার করতে চাই।
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল–এর গবেষণা বলছে, ডোপামিন কেবল আনন্দই নয়, মনোযোগ, স্মৃতি, ঘুম ও চলাচল নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ডোপামিনের অভাব মানুষকে আনন্দহীন করে দেয়। ছবি/প্রতীকী
ডোপামিনের অভাব হলে
ডোপামিনের অভাব বা ঘাটতি হলে মানুষ সাধারণত ক্লান্ত, অনুৎসাহী ও বিষণ্ন বোধ করে। অতিরিক্ত ঘুম, কর্মে আগ্রহহীনতা বা আনন্দহীনতা দেখা দিতে পারে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ–এর তথ্য অনুযায়ী, ডোপামিন কমে গেলে ডিপ্রেশন, পারকিনসন রোগ এবং অ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিসঅর্ডার (এডিডি)–এর ঝুঁকি বাড়ে।
ডোপামিন বেশি হলে কী হয়
আবার অতিরিক্ত ডোপামিন নিঃসরণ মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এতে মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে, ঘন ঘন উত্তেজিত হয়ে পড়ে বা মনোযোগ হারায়। আমেরিকান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি–এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ডোপামিনের সঙ্গে স্কিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিসঅর্ডার–এর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

অতিরিক্ত ডোপামিনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক আছে কিছু মানসিক রোগের। ছবি/প্রতীকী
ডোপামিন আসক্তি বা আনন্দের ফাঁদ
ডোপামিন কম বা বেশি হলে স্বাভাবিক জীবন প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়। এ কারণেই আমারা সারাদিনে পুরোসময় সুখে বা দুঃখে থাকি না। দুটোর ভারসাম্য আমাদের সুস্থ রাখে। তবে জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ ও দুঃখের প্রবাহ যখন অন্যকিছুর কারণে প্রভাবিত হয়, তখনই শুরু হয় সমস্যা।
তাই আজকের ডিজিটাল যুগে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ডোপামিন আসক্তি। সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও গেম, অনলাইন শপিং বা শর্ট ভিডিওর নোটিফিকেশন — সবকিছুই আমাদের মস্তিষ্ককে বারবার ছোট ছোট ডোপামিন পুরস্কার দেয়। এতে মস্তিষ্ক ‘তাৎক্ষণিক আনন্দে’ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে অনেকেই সাধারণ কাজ, পড়াশোনা বা সামাজিক যোগাযোগে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. অ্যান্ড্রু হুবারম্যান বলেছেন, ‘আমরা যত দ্রুত আনন্দ খুঁজি, ততই মস্তিষ্কের ডোপামিন ভারসাম্য নষ্ট হয়, ফলে সাধারণ জিনিসে আনন্দ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।’
তাই নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে অবশ্যই ডোপামিনের ভারসাম্যে গুরুত্ব দিন।

যোগব্যায়াম ডোপামিন নিঃসরণকে প্রাকৃতিকভাবে বাড়ায়। ছবি/প্রতীকী
ডোপামিনের ভারসাম্য রাখতে ৫টি সহজ অভ্যাস
১. ঘুম ঠিক রাখুন: পর্যাপ্ত ঘুম মস্তিষ্কের ডোপামিন উৎপাদন ও রিসেপ্টর পুনর্গঠনে সাহায্য করে।
২. নিয়মিত ব্যায়াম করুন: হাঁটা বা যোগব্যায়াম ডোপামিন নিঃসরণকে প্রাকৃতিকভাবে বাড়ায়।
৩. ডিজিটাল বিরতি নিন: প্রতিদিন কিছু সময় মোবাইল বা স্ক্রিন থেকে দূরে থাকলে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম পুনরুদ্ধার হয়।
৪. প্রকৃতির সংস্পর্শে যান: খোলা বাতাস, সবুজ গাছপালা ও সূর্যের আলো ডোপামিন বাড়াতে সহায়ক।
৫. দীর্ঘমেয়াদি তৃপ্তির অভ্যাস গড়ুন: বই পড়া, গান শেখা বা স্বেচ্ছাসেবায় যুক্ত থাকা মস্তিষ্কে ভারসাম্যপূর্ণ আনন্দ তৈরি করে।
সূত্র: হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল (২০২২), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ (২০২৩), আমেরিকান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি (২০২০), স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি – ড. অ্যান্ড্রু হুবারম্যান (২০২১)
এএমপি/জিকেএস
এডমিন 







